সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিংশ শতকের শেষার্ধে আবিভুর্ত একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিস্টোব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বাঙলাভাষী এই ভারতীয় সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় "নীললোহিত", "সনাতন পাঠক" ও "নীল উপাধ্যায়" ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা

একটি কথা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটি কথা বাকি রইলো থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।
ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাশা
বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছুই না
রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া
রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা।
বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছু না
একটি কথা বাকি রইল, থেকেই যাবে।


গদ্যছন্দে মনোবেদনা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভেবেছিলাম নিচু করবো না মাথা, তবুও ভেতরের এক কুত্তার বাচ্চা
মাঝে মাঝে মসৃণ পায়ের কাছে ঘষতে চায় মুখ, জানি তো অসীমে
ভাসিয়েছি আমার আত্মার শাদা পায়রা দূত, বলেছি মৃত্যুর চেয়েও সাচ্চা
মানুষের মতো বেঁচে থঅকা- তবু তার দু’একটা পালক খসে
জ্যোস্নায় মনখারাপ হিমে।
মাঝে মাঝে গদি মোড়া চেয়ারে বসলেও ব্যথা করে পশ্চাৎদেশে, আমি জানি
আচম্বিতে পেয়ালা পিরীচ ভেঙে উঠে দাঁড়ানো উচিত ছিল আমার
জানলার বাইরে থেকে নিয়তি চোখ মারে, শীর্ণ হাতে দেয় হাতছানি
আমি মনকে চোখ ঠেরে অন্যমনস্ক হই, ইস্ত্রি ঠিক রাখি জামার।
এ-সব ইয়ার্কি আর কদ্দিন হে? শুধু বেঁচে থাকতেই হালুয়া
টাইট করে দিচ্ছে
অথচ কথা ছিল, সব মানুষের জন্য এই পৃথিবী সুসহ দেখে যাবো,
ঠিক যে-রকম
প্রত্যেক মৌমাছির আছে নিজস্ব খুপরি, কিন্তু যার যখন ইচ্ছে
উড়ে যাবার স্বাধীনতা : ফুলের ভেতরে মধু সে জেনেছে, তবু
সঙ্গসভ্যতার জন্য তার শ্রম।।


নশ্বর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কখনো কখনো মনে হয়, নীরা, তুমি আমার
জন্মদিনের চেয়েও দূরে
তুমি ঝরাপাতা অরণ্যে হেঁটে চলো
তোমার মসৃণ পায়ের নিচে পাতা ভাংগার শব্দ
দিগন্তের কাছে মিশে আছে মোষের পিঠের মতন
পাহাড়
জয়ডঙ্কা বাজিয়ে তাঁর আড়ালে ডুবে গেল সূর্য
এসবই আমার জন্মদিনের চেয়েও দূরের মনে হয় ।

কখনো কখনো আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়ে
নক্ষত্রের মৃত্যু
মনের মধ্যে একটা শিহরণ হয়
চোখ নেমে আসে ভূ-প্রকৃতির কাছে ;
সেই সব মূহুর্তে, নীরা, মনে হয়
নইশ্বরতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নেমে পড়ি
তোমার বাদামী মুষ্টিতে গুঁজে দিই স্বর্গের পতাকা
পৃথিবীময় ঘোষণা করে দিই, তোমার চিবুকে
ঐ অলৌকিক আলো
চিরকাল থমকে থাকবে !
তখন বহুদূর পাতা-ঝরা অরণ্যে দেখতে পাই
তোমার রহস্যময় হাসি-
তুমি জানো, স্বন্ধেবেলার আকাশে খেলা করে সাদা পায়রা
তারাও অন্ধকারে মুছে যায়, যেমন চোখের জ্যোতি-এবং পৃথিবীতে
এত দুঃখ
মানুষের দুঃখই শুধু তাঁর জন্মকালও ছাড়িয়ে যায় ।


প্রতীক্ষায়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

গোলাপে রয়েছে আঁচ, পতঙ্গের ডানা পুড়ে যায়
হাওয়া ঘোরে দূরে-দূরে
ফুলকে সমীহ করে
সূর্যাস্তও থমকে থাকে!
দেখো-দেখো
আমার বাগানে এক অগ্নিময় ফুল ফুটে আছে
তার সৌরভেও কত তাপ!
আর সব কুসুমের জীবন-চরিত তুচ্ছ করে
সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে চতুর্দিক
বৈদুর্ষমণির মতো চোখ মেলে সে রয়েছে প্রতীক্ষায়
কার? কার?


ভালবাসি, ভালবাসি
—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,রাত জেগে পড়ার
টেবিলে বসে আছ,
ঘুম আসছে না তোমার
হঠাত করে ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি বললাম-
ভালবাস? তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো ক্লান্ত তুমি, অফিস থেকে সবে ফিরেছ,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত..
খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই,
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘর্মাক্ত আমি তোমার
হাত ধরে যদি বলি- ভালবাস?
তুমি কি বিরক্ত হবে?
নাকি আমার হাতে আরেকটু
চাপ দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম শশব্যস্ত
হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে,মাথার উপর
তপ্ত রোদ,বাহন
পাওয়া যাচ্ছেনা এমন সময় হঠাত দাঁড়িয়ে পথ
রোধ করে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার দিকে তাকিয়ে কাঁধে হাত
দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো শেভ করছ তুমি,গাল কেটে রক্ত পড়ছে,এমন সময়
তোমার এক ফোঁটা রক্ত হাতে নিয়ে যদি বলি-
ভালবাস?
তুমি কি বকা দেবে?
নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত আমার
গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল
গলায় বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো খুব অসুস্থ তুমি,জ্বরে কপাল পুড়ে যায়,
মুখে নেই রুচি, নেই কথা বলার
অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে তোমার
মুখের
দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?নাকি তোমার গরম
শ্বাস আমার
শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,প্রচন্ড
যুদ্ধে তুমিও অঃশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাস? ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও?
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস
দেবে,বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ
তুমি,দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরুতে যাবে,হঠাত
বাধা দিয়ে বললাম-ভালবাস? কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত
বুলাতে বুলাতে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি
ধরো প্রচন্ড ঝড়,উড়ে গেছে ঘরবাড়ি,আশ্রয় নেই
বিধাতার দান এই
পৃথিবীতে,বাস করছি দুজনে চিন্তিত তুমি
এমন সময় তোমার
বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালবাস?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-ভালবাস?
চুপ করে থাকবে?নাকি সেখান থেকেই
আমাকে বলবে ভালবাসি, ভালবাসি..
যেখানেই যাও,যেভাবেই থাক,না থাকলেও দূর
থেকে ধ্বনি তুলো
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি..
দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর,বুঝব
তুমি আছ,তুমি আছ
ভালবাসি, ভালবাসি….

পাহাড় চূড়ায়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
… কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
… যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই
কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই।

নদীটাও অবশ্য কিনেছিলামি একটা দ্বীপের বদলে।
ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো,
ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।
সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।
শৈশবে দ্বীপটি ছিল আমার বড় প্রিয়।
আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার
কাছে মাপে ছোট লাগলো। প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।
বন্ধুরা বললো, ঐটুকু
একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড়
একটা নদী পেয়েছিস?
খুব জিতেছিস তো মাইরি!
তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।
তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।
নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।
যেমন, বলো তো, আজ
সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?
সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।
শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,
সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!
আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না,
সে জানতো! সবাই জানে।
শৈশবে আর ফেরা যায় না।

এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ
কঠিন পাহাড়।
একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কন্ঠস্বর সেখানে কেউ
শুনতে পাবে না।
আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,
প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-
এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।
হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।
আমাকে ক্ষমা করো।


একবারই জীবনে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুই হাতে মৃত্যু নিয়ে ছেলেখেলা করার বিলাস
প্রথম যৌবনে ছিল ।
ভাবতাম,
নদীর আকাশে লঘু মাছরাঙা পাখির মতন
মৃত্যুর দু’ধারে ঘেঁষে ছুটোছুটি
জীবনকে রূপরস দেয় ।
বারবার
আমি কি যাইনি সেই মৃত্যুমুখী দক্ষিণের ঘরে ?
বাঁধের কিনার থেকে গড়ানো বন্ধুর হাত ধরে থাকা
আন্তরিক মুঠি
যমদন্ড দেখেছিল ।
যৌবনে এসবই খেলা ।
যখন মানুষ মরে, একবারই জীবনে মরে,
তারপর আর কোন খেলা নেই ।
আর কোন অস্পষ্টতা, নদীর কিনারে বসে থাকা নেই ।
হঠাৎ বিমান থেকে বাচাল মেশিনগান ফুঁড়ে যায় দেহ
এখন যা শকুন ও কুকুরের ভাগ্য
আর কোন খেলা নেই ।


এখন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দারুণ সুন্দর কিছু দেখলে আমার একটু একটু
কান্না আসে।
এমন আগে হতনা,
আগে ছিল দুরন্ত উল্লাস,
আগে এই পৃথিবীকে জয় করে নেবার বাসনা ছিল
এখন মনে হয় আমার এই পৃথিবীটা
বিলিয়ে দেই সকলকে
পরশুরামের মত রক্তস্নান সেরে
চলে যাই দিগন্ত কিনারে
যত সব মানুষকে চিনেছি, তাদের ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়
নাও, যার যা খুশি নাও,
শিশির ভেজা মাঠে শুয়ে থাক কিছু সুখী মাথা ।


এক একদিন উদাসীন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এমনও তো হয় কোনোদিন
পৃথিবী বন্ধবহীন
তুমি যাও রেলব্রীজে এক-
ধূসর সন্ধ্যায় নামে ছায়া
নদীটিও স্থিরকায়া
বিজনে নিজের সঙ্গে দেখা।
ইস্টিশানে অতি ক্ষীণ আলো
তাও কে বেসেছে ভালো
এত প্রিয় এখন দ্যুলোক
হে মানুষ, বিস্মৃত নিমেষে
তুমিও বলেছো হেসে
বেঁচে থাকা স্বপ্নভাঙা শোক!
মনে পড়ে সেই মিথ্যে নেশা?
দাপটে উল্লাসে মেশা
অহঙ্কারী হাতে তরবারী
লোভী দুই চক্ষু চেয়েছিল
সোনার রূপোর ধুলো
প্রভুত্বের বেদী কিংবা নারী!
আজ সবকিছু ফেলে এলে
সূর্য রক্তে ডুবে গেলে
রেলব্রীজে একা কার হাসি?
হাহাকার মেশা উচ্চারণে
কে বলে আপন মনে
আমি পরিত্রাণ ভালোবাসি!


বয়েস
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার নাকি বয়েস বাড়ছে ? হাসতে হাসতে এই কথাটা
স্নানের আগে বাথরুমে যে ক’বার বললুম !
এমন ঘোর একলা জায়গায় দু-পাক নাচলেও
ক্ষতি নেই তো-
হাসতে হাসতে দম ফেটে যায়, বিকেলবেলায়
নীরার কাছে
বলি, আমার বয়েস বাড়ছে, শুনেছো তো ? ছাপা হয়েছে ?
সত্যি সত্যি বুকের লোম, জুলপি, দাড়ি কাঁচায় পাকা-
এই যে দ্যাখো, চেয়ে দ্যাখো
দেখে সবাই বলবে না কি, ছেলেটা কই, ও তো লোকটা !
এ সব খুব শক্ত ম্যাজিক, ছেলে কিভাবে লোক হয়ে যায়
লোকেরা ফের বুড় হবেই এবং মরবে
আমিও মরবো
আরও খানিকটা ভালোবেসে, আরও কয়েকটা পদ্য লিখে
আমিও ঠিক মরে যাবো,
কী, তাই না ?
ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এলুম, এ-জায়গাটা আত অচেনা
আমার ছিল বিশাল রাজ্য, তার বাইরেও এত অসীম
শরীরময় গান-বাজনা, পলক ফেলতেও মায়া জাগে
এই ভ্রমণটা বেশ লাগলো, কম কিছু তো দেখা হলো না
অন্ধকারও মধুর লাগে, তোমার হাতটা দাও তো
সুগন্ধ নিই !
নীরা, শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি
সময় আজো থেমে আছে ।


ছবি খেলা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মনে আছে সেই রাত্রি? সেই
চাকভাঙা
মধুর মতন জ্যোৎস্না
উড়ো উড়ো পেঁজা মেঘ অলীক
গর্ভের প্রজাপতি
দুগ্ধবর্ণ বাতাসের
কখনো স্পর্শ ও ছবি খেলা
মিনারের মতোন পাঁচটি প্রচীন
সুউচ্চ গাছ, সেই
মানবিক চষা মাঠ, তিনটি দিগন্ত
দূর, আরও দূর
পুকুরের ঢালু
পাড়ে তুমি শুয়ে ছিলে
মনে আছে সেই রাত্রি, সঠিক
পথেই ঠিক
ভুল করে যাওয়া?
বুকে কেউ চোখ ঘষে, ঊরুদ্বয়ে,
ভেঙে যায় ঘুম
হঠাৎ প্রবাসী গল্প, ফিসফাস,
শব্দ এসে
শব্দকে লুকোয়
অশ্রুর লবণ
থেকে উঠে আসে স্মৃতিকথা,
পিঠে
কাঁকর ও তৃণাঙ্কুর, অথচ এমন
রাত্রি, এমন
জ্যোৎস্না মৃদু ঢেউ
কখনো দেখোনি কেউ, সমস্ত
শরীরে আলো যেন
খুব জলের গভীরে
সাবলীল ভেসে যাওয়া, কত দেশ কত
নদী এমনকি
মনুষজন্ম পার হয়ে এসে
যেমন ফুলের বুকে ঘ্রাণ
কিংবা ঘ্রান ছেঁচে
জন্ম নেয় ফুল
মনে পড়ে সেই রাত্রি? সঠিক
পথেই ঠিক
ভুল করে যাওয়া


একটা দুটো ইচ্ছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটা দুটো ইচ্ছে আমায় ছুটি দিচ্ছে না
যাবার কথা ছিল আমার সাড়ে ন’টার ট্রেনে
ছিল অটুট বন্দোবস্ত, রাত-পোশাকের বোতাম
তিনিতে বাতিঘর পেরুলেই সীমা-সুখের স্বর্গ
একটা দুটো ইচ্ছে আমায় ছুটি দিচ্ছে না ।

খেলাচ্ছলে দেখা হলো, খেলা ভাঙল রাতে
শরীরময় জড়িয়ে রইলো সুদূরপন্থী হাওয়া
নদীর মতো নারীর ঘ্রাণ মোহ মধুর স্মৃতি
সবই বুকের কাছাকাছি , যেমন কাছে আকাশ
একটা দুটো ইচ্ছে তবু ছুটি দিচ্ছে না ।


আত্মকাহিনী
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রোজ সকালে শুয়ে শুয়ে ভাবি উঠি কিনা উঠি,
সামনে টেবিলে চায়ের পেয়ালা সেকা পাউরুটি।
সতেজ কাগজে পরিচিত ঘ্রাণ, চেনা সংবাদ
বন্যা, মন্ত্রী, শান্তির বাণী, শরিকি বিবাদ।
জানালার পাশে এই সংসার দিল তার ডাক
থাক আলস্য, এইবার তাহলে উঠে পড়া যাক।
গত রাত্রিকে বিছানায় ফেলে বাইরে এলাম
চোখে মুখে গায়ে পৃথিবী লিখলো সূর্যের নাম
সে নাম থাকবে চিরদিন ধরে চিহ্নের মতো
যেন আমি জীবিকার পথে ঘুরি ক্রমাগত।
চোখের আড়ালে এসে চলে যায় বর্ষা শরৎ
যাকে চাই তাকে ভুলে গিয়ে শুধু খুঁজে ফিরি পথ।
দিনের যুদ্ধে সমস্ত আশা নিঃশেষ হলে
রাত্রি তার প্রেয়সীর মত আভরণ খোলে।
তার রূপ যেন মৃত্যুর মত ম্লান মনে হয়
সঁপে দেই তাকে নিজের ব্যর্থ ক্লান্ত হৃদয়।
শুধু মনে মনে প্রার্থনা করি অস্ফুট স্বরে,
নতুন দৃশ্য ঘুম ভেঙে যেন দেখি কাল ভোরে।


এই দৃশ্য
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

হাঁটুর ওপরে থতনি, তুমি বসে আছো
নীল ডুরে শাড়ী, স্বপ্নে পিঠের ওপরে চুল খোলা
বাতাসে অসংখ্য প্রজাপতি কিংবা সবই অভ্রফুল?
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
চোখ দুটি বিখ্যাত সুদূর, পায়ের আঙুলে লাল আভা।
ডান হতে, তর্জনিতে সামান্য কালির দাগ
একটু আগেই লিখছিলে
বাতাসে সুগন্ধ, কোথা যেন শুরু হলো সন্ধ্যারতি
অন্যদেশ থেকে আসে রাত্রি, আজ কিছু দেরি হবে
হাঁটুর ওপরে থুথনি, তুমি বসে আছো
শিল্পের শিরায় আসে উত্তেজনা, শিল্পের দু’চোখে
পোড়ে বাজি
মোহময় মিথ্যেগুলি চঞ্চল দৃষ্টির মতো, জোনাকির মতো উড়ে যায়
কোনোদিন দুঃখ ছিল, সেই কথা মনেও পড়ে না
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
সময় থামে না জানি, একদিন তুমি আমি সময়ে জড়াবো
সময় থামে না, একদিন মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে
দিগন্ত পেরিয়ে-
নতুন মানুষ এসে গড়ে দেবে নতুন সমাজ
নতুন বাতাস এসে মুছে দেবে পুরোনো নি:শ্বাস,
তবু আজ
হাঁটুর ওপরে থুতনি,তুমি বসে আছো
এই বসে থাকা, এই পেঠের ওপরে খোলা চুল,
আঙুলে কালির দাগ
এই দৃশ্য চিরকাল, এর সঙ্গে অমরতা সখ্য করে নেবে
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো…


দুপুর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোরই শস্য, দুপুরের অস্থির কুহক
অলিন্দে দাঁড়ানো মূর্তি ঢেকে দিল দু’চক্ষুর সীমা
পথ চলতে থম্কে গেলো অপ্রতিভ অসংখ্য যুবক।
ভিজে চুল খুলেছে সে সুকুমার, উদাস আঙুলে
স্তনের বৃন্তের কাছে উদ্বেলিত গ্রীষ্মের বাতাস
কি যেন দেখলো মিলে এক সঙ্গে নিল দীর্ঘশ্বাস।

একজন যুবক শুধু দূর থেকে হেঁটে এসে ক্লান্ত রুক্ষ দেহে
সিগারেট ঠোঁটে চেপে শব্দ করে বারুদ পোড়ালো
সম্বল সামান্য মুদ্রা করতলে গুণে গুণে দেখলো সস্নেহে
এ মাসেই চাকবি হবে, হেসে উঠলো, চোখে পড়লো
অলিন্দের আলো।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, নির্লিপ্তের মতো চেয়ে বললো মনে মনে
কিছুদূর হেঁটে গিয়ে শেষবার ফিরে দেখলো তাকে
রোদ্দুর লেগেছে তার ঢেকে রাখা যৌবনের প্রতি কোণে কোণে
এ যেন নদীর মতো, নতুন দৃশ্যের শোভা প্রতি বাঁকে বাঁকে।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, যুবকটি মনে মনে বললো বারবার
রোদ্দুর মহৎ করে মন, আমি চাই শুধু ক্লান্ত অন্ধকার।।


একটি চিঠি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বলাকা তোমার শুভ্র চোখেতে পায়নি ঘুম ?
জানোনা কি এটা কুয়াশায় ঢাকা
রাত নিঝুম !
স্বপ্ন দেখো না ? এখনো কি তার
সময় নয় ?
বলাকা, তুমি কি পেয়েছো ভয় ?
জানো নাকি আমি পথে ঘুরে-ঘুরে দিশেহারা-
আকাশের মায়া গান গেয়ে করে
গৃহছাড়া।
তোমার বাশিতে ফুঁ দিয়েছি আমি
সেই ধ্বনি-
বলাকা এই কি জাগরণী ?
মরু পর্বতে ঘুর্ণিঝড় যে হোল শুরু ।
আকাশের বুকে মেঘশিশুদের
গুরু গুরু ।
হিংস্র নখর এখনো লুকোয় বাকে-বাকে
সরল কুমারী বোকা চোখে শুধু
চেয়ে থাকে ।
সমুদ্র-ঝড় আসেনি এখনো মনে-মনে ?
বলাকা-হৃদয় এখনও কি শুধু দিন গোনে ।
মন উত্তাল পাখি শুধু ডাকে বোবা যুগে ,
ফেরারী বাহিনী বছর কাটায়
উদ্যোগে ।
মনের সূর্য তবুও ভাংবে অন্ধ ঘোর
বলাকা, তুমি কি দেখনি ভোর ?
হৃদয় জাগানো পরশমণির সন্ধানেই
তাই তো অলস দুপুর যাপনে
শঙ্কা নেই ।
স্বপ্ন-সাগরে দিয়েছি নিজেকে
বিসর্জন
বলাকা, তোমার গ্রন্থি হবেনা উন্মোচন ?
(সুনীলদার প্রথম প্রকাশিত কবিতা, দেশ, ৩১শে মার্চ ১৯৫১)


বনমর্মর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সেই পথ দিয়ে ফিরে যাওয়া
পড়ে আছে মিহিন কাচের মতো জ্যোৎস্না
শুকনো পাতার শব্দ এমন নিঃসঙ্গ
সেই সব পাতা ভেঙে
ভেঙে ভেঙে ভেঙে ভেঙে চলে যেতে
যেতে যেতে যেতে যেতে
বাতাসের স্পর্শ যেন কার যেন কার যেন কার যেন কার ?
মনেও পড়েওনা ঠিক যেন কার আঙ্গুলি
এই মুখে, রুক্ষ মুখে, আমার চিবুকে, এই কর্কশ চিবুকে
ঠোঁটে, ঠোটের ওপরে, এবং ঠোটের নিচে
চোখের দু’পাশে যে কালো দাগ সেখানেও
যেন কার, যেন কার কোমল অঙ্গুলি ?
কপালে হিঙ্গুল টিপ, নীলরঙ্গা হাসি
পেছনে তাকাই আর দেখা যায় না
জ্যোৎস্না নেই, বোবা কালা অন্ধকার
শুকনো পাতার শব্দ…
সেই পথ দিয়ে ফিরে যাওয়া , ফিরে যেতে যেতে যেতে!


কই, কেউ তো ছিলো না
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কেউ ভালোবেসে ভুল করে, কেউ কেউ ভালোই বাসেনা
কেউ কেউ চতুরতা দিয়ে খায় পৃথিবীকে, কেউ কেউ বেলা যায়
ফিরেও আসে না ।

ওপরে চাঁদের কাছে মেঘ জমে পাহাড়ের মেষ তৃণে আগুন
লেগেছে
যাদের বাঁচার কথা ছিল, নেই, ভুল মানুষেরা আছে বেঁচে ।

স্বপ্ন বারবার ভাঙে, তবু ফের স্বপ্ন উপাদান দেয় অচেনা নারীরা
তাদের গলায় দোলে রক্তমাখা অত্যুজ্জল ধাতুমালা, পান্না কিংবা
হীরা !

আমার যা ভালোবাসা, কাঙালের ভালোবাসা, এর কোন মূল্য
আছে নাকি ?
এ যেন জলের ঝারি, কেউ দেখা দেবে বলে হঠাৎ মিলিয়ে যায়
বাবলা কাটার ঝোপে
যেমন জোনাকী !

সুধা ভ্রমে বিষ খাই, বিষ এত মিষ্টি বুঝি ? তবে যে সকলে
বলো লোনা ?
আমাকে মৃত্যুর হাতে ফেলে ওরা চলে যায়, বারবার
ওরা মানে কারা ?
কই, কেউ তো ছিলো না !


শিশুরক্ত
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দ’দিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়-
বয়ষ্করা এমনই উন্মাদ ।
তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি !
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই ?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে !
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই ।


সখী আমার
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশি, আমায় ভুল বুঝবে?
শরীর ছেনে আশ মেটে না, চক্ষু ছুঁয়ে আশ মেটে না
তোমার বুকে ওষ্ঠ রেখেও বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়
যেন আমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার
দিঘির পাড়ে বকের সাথে দেখা হলো না!

সখী, আমার পায়ের তলায় সর্ষে, আমি
বাধ্য হয়েই ভ্রমণকারী
আমায় কেউ দ্বার খোলে না, আমার দিকে চোখ তোলে না
হাতের তালু জ্বালা ধরায়, শপথগুলি ভুল করেছি
ভুল করেছি
মুহুর্মুহু স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্নে আমার ফিরে যাওয়ার
কথা ছিল, স্বপ্নে আমার স্নান হলো না।

সখী, আমার চক্ষুদুটি বর্ণকানা, দিনের আলোয়
জ্যোৎস্না ধাঁধা
ভালোবাসায় রক্ত দেখি, রক্ত নেশায় ভ্রমর দেখি
সুখের মধ্যে নদীর চড়া, শুকনো বালি হা হা তৃষ্ণা
হা হা তৃষ্ণা
কীর্তি ভেবে ঝড়ের মুষ্টি ধরতে গেলাম, যেন আমার
ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার
স্বরূপ দেখা শেষ হলো না।


স্মৃতির শহর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মধ্যরাত্রির খটখটে জেগে ওঠার মধ্যে তোমার স্বপ্ন দেখি
হে গাঢ় নীল জ্যোৎস্নার মতন বিচ্ছেদ-বেদনা
হে বরাকর বাংলোর মতন ঝুকে পড়া অপরাহ্ণ
হে প্রচ্ছন্ন অভিমান!
মনে পড়ে ওভাররীজের উপর দাড়িয়ে হলুদ হাতছানি
দেবী স্বরসতীর স্তনের মতন রাংগা-রাঙ্গা চাঁদ
একটি টিট্টিভের ডাক
দেবদারু পাতার সরসর শব্দে জেগে ওঠে যৌবনের একটি দিন
একটি বৃন্তচ্যুত অনিত্য
কলেজ-পালানো কিছু ভালো না লাগা রাস্তা
আমায় নিয়ে যায় ছন্নছাড়া দেশে
যেখানে হঠাত ঝলসে ওঠে অলৌকিক বাস্তব
দিগন্তে পাহাড় মেলে দিয়েছে তার ঐশ্বর্যময়ী উরু
বুক জ্বালা নেশা নয়, এমনই একাকীত্ব
লন্ঠন দুলিয়ে দুলিয়ে একজন কেউ চলে যায়,
সে আর ফিরবেনা ।
কালোর হৃদয় চেরা কালো, তারও ভেতরের নিবিড় সরল কালো
অবিকল একটি শিশুর মতন
লাফিয়ে পড়ে নদীর জলে
সে আমার বাতাসে উদাস করা মন খারাপ ।
সমস্ত নির্জনতার ভেতর থেকে ঐরাবতের মতন উঠে আসে
আমার পরাজয়
হে আমার দিগন্ত কুন্তলা মৃত্যু, হে ভোগবতী
সেই টিলার শিয়রে স্বন্ধ্যায় সর্বাঙ্গে বৃষ্টির মতন শিহরণ
বড় প্রিয়, যেন শুধু চোখে চোখ রাখা
জেগে উঠি মধ্যরাত্রে, যাকে না-দেখার
তাকে স্বপ্ন দেখি ।


সিড়ির উপরে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কোন ঘরে জায়গা নেই, তুমি আমাকে
বসতে বললে সিড়িতে
আঁচল দিয়ে ধুলো মুছতে যাচ্ছিলে, আমি বললাম, থাক!
আমার মুখের ঘাম মোছার ইচ্ছে ছিল ঐ আচলে
কিন্তু সেটা ছড়িয়ে রইল মাঝখানে প্রবাদের খড়গের মতন
তার উপর দিয়ে উড়ে যায় স্পর্শকাতর বাতাস ।
সিড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে যখন তখন জেগে উঠে পদশব্দ
আমি সংকুচিত হয়ে বসি, ইচ্ছাশক্তিতে কোন মানুষ
অদৃশ্য হতে পারেনা !
অচেনা দৃষ্টিগুলি আমার শরীরে বেঁধে, নীরা, তুমি হেসে ওঠো
তোমার বিমূর্ত হাসিতে সিড়ি হইয়ে যায় জলপ্রপাতের কিনারা
যীখানে ঝুকে আছে স্নেহময় বৃক্ষ,
জলে খেলা করে পাতার ছায়া
নব ভ্রুপল্লব, নব বেদনাময় আহবান!
তোমার নরম স্থিতি থেকে আমার বাসনা অনেক দূরে
তবু সিড়ির উপরে বহুদিনের বিচ্ছেদ বেদনা ধুলো হয়ে গেল ।


জুয়া
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় জীবন বদলে নিলাম আমি ও নিখিলেশ,
হাতঘড়ি ও কলম, পকেট বই, রুমাল-
রেডিওতে পাঁচটা বাজলো, আচ্ছা কাল
দেখা হবে,- বিদায় নিলাম,- সন্ধেবেলার রক্তবর্ণ বাতাস ও শেষ
শীতের মধ্যে, একা সিঁড়ি দিয়ে নামবার
সময় মনে পড়লো- ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার
এসবও বদলানো দরকার, যেমন মুখভঙ্গী ও দুঃখ, হাসির মুহূর্ত
নিখিলেশ ক্রুদ্ধ ও উদাসীন, এবং কিছুটা ধূর্ত।
হাল্‌কা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমি নিখিলেশ হয়ে বহুদূর
হেঁটে গেলাম, নতুন গোধূলি ও রাত্রি, বাড়ি ও দরজা এমনটি অন্তঃপুর
ঘুঁমোবার আগে চুরুট, ঘুমের গভীরতা ও জাগরণ-
ছ’লক্ষ অ্যালার্ম ঘড়ি কলকাতার হিম আস্তরণ
ভাঙার আগেই আমি, অর্থাৎ নিখিলেশ, টেলিফোনে নিখিলেশ
অর্থাৎ সুনীলকে
ডেকে বলি, তুই কি রোড কন্ডেন্স্‌ড্‌ মিল্কে
চা খেতিস? বদ গন্ধ, তা হোক! আমি অর্থাৎ পুরোনো সুনীল,
নিখিলেশ এখন,
তোর অর্থাৎ পুরোনো নিখিল অর্থাৎ নতুন সুনীলের সিংহাসন
এবং হৃঃপিন্ড ও শোণিত
পেতে চাই, তোর পুরোনো ভবিষ্যৎ কিংবা আমার নতুন অতীত
তোর নতুন অতীতের মধ্যে, আমার পুরোনো ভবিষ্যতে
(কিংবা তোর ভবিষ্যতে আমার অতীত কোনো পঞ্চম অতীত ভবিষ্যতে)
কিংবা তোর নিঃসঙ্গতা, আমার না-বেঁচে-থাকা হৈ-হৈ জগতে
দু’রকম স্মৃতি ও বিস্মরণ, যেন স্বপ্ন কিংবা স্পপ্ন বদলের
বীয়ার ও রামের নেশা, বন্ধুহীন, বন্ধু ও দলের
আড়ালে প্রেম ও প্রেমহীনতা, দুঃখ ও দুঃখের মতো অবিশ্বাস
জীবনের তীব্র চুপ, যে-রকম মৃতের নিঃশ্বাস,-
লোভ ও শান্তির মুখোমুখি এসে আমার পূজা ও নারীহত্যা
তোর দিকে, রক্ত ও সৃষ্টির মধ্যে আমি অগত্যা
প্রেমিকার দিকে যাবো, স্তনের ওপরে মুখ, মুখ নয়, ধ্যান ও অসি’রতা
এক জীবনে, ঊরুর সামনে ঊরু, ঊরু নয়, যোনির সামনে লিঙ্গ, অশরীরী,
ঘৃণা ও মমতা
অসম্ভব তান্ডব কিংবা চেয়ে দেখা মুহূর্তের রৌদ্রে কোনো কুরূপা অস্পরী
শীত করলে অন্ধকারে শোবে। দুপুরে হঠাৎ রাস্তায় আমি তোকে
সুনীল সুনীল বলে ডেকে উঠবো, পুরোনো আমার নামে, দেখতে চাই চোখে
একশো আট পল্লব কাঁপে কি না, কতটা বাতাস লাগে গালে ও হৃদয়ে
ক’হাজার আলপিন, কত রূপান্তর জন্মে, শোকে পরাজয়ে,
সুখ, সুখ নয় পাপ, পাপ নয়, দোলে, দোলে না, ভাঙে, ভাঙে না, মৃত্যু, স্রোতে
আমি, ও আমার মতো, আমার মতো ও আমি, আমি নয়,
এক জীবন দৌড়াতে দৌড়াতে।।


কঙ্কাল ও শাদা বাড়ি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শাদা বাড়িটার সামনে আলো-ছায়া-আলো, একটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে
এখন দুপুর রাত অলীক রাত্রির মতো, অররণা রয়েছে খুব ঘুমে-
যে-রকম ঘুম শুধু কুমারীর, যে ঘুম স্পষ্টত খুব নীল;
যে স্তনে লগৈনি দাঁত তার খুব মৃদু ওঠপড়া
তলপেটে একটুও নেই ফাটা.দাগ, এ শরীর আজও ঋণী নয়
এই সেই অরুণা ও রুনি নাম্মী পরা ও অপরা
সুখ ও আসুখ নিয়ে ওষ্ঠাধর, এখন রয়েছে খুব ঘমে
যে-রকম ঘুম শুধু কুমারীর, যে-ঘুম স্পষ্টত খুব নীল।
সন্ন্যাসীর সাহসের মতো আন্ত অন্ধকার, কে তুমি কঙ্কাল-
প্রহরীর মতো, কেন বাধা তিদে চাও? কী তোমার ভাষা?
ছাড়ো পথ, আমি ঐ শাদা বাড়িটার মধ্যে যাবো।
করমচা ফুলেরঘ্রণ আলপিনের মতো এসে গয়ে লাগে
থামের আড়োলে থেকে ছুটে এলো হাওয়া, বহু ঘুমের নিশ্বাস
ভরা হাওয়া
আমি অরুণার ঘুমে এক ঘুম ঘুমোতে চাই আজ মধ্য রাতে
অরুণার শাড়ি ও শায়ার ঘুম, বুকে ঘুম, কুমারী জন্মের
পবিত্র নরম ঘুম, আমি ব্রাহ্মণের মতো তার প্রার্থী।
নিরস্ত্র কঙ্কাল, তুমি কার দূত? তোমার হৃদয় নেই, তুমি
প্রতীক্ষার ভঙ্গি নিয়ে কেন প্রতিরোধ করে আছো?
অরুণা ঘুমন্ত, এই শাদা বাড়িটার দ্বারে তুমি কেন জেগে?
অরুণা ঘুমন্ত, এই শাদা বাড়িটার দ্বরে তুমি কেন জেগে?
তুমি ভ্রমে বদ্ধ, তুমি ওপাশের লাল রঙা প্রাসাদের কাছে যাও
ঐখানে পাশা খেলা হয়, হু-রে-রে চিৎকরে ওঠে হৃদয়ে শকুনির
ঝটাপটি, তুমি যাও
ছাড়ো পথ, আমি এই নিদ্রিত বাড়ির মধ্যে যাবো।।


নীরা, তুমি….
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীরা,তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী-সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি!

বড় দেরি হয়ে গেল, আকাশে পোশাক হতে বেশি বাকি নেই
শতাব্দীর বাঁশবনে সাংঘাতিক ফুটেছে মুকুল
শোনোনি কি ঘোর দ্রিমি দ্রিমি?
জলের ভিতর থেকে সমুত্থিত জল কথা বলে
মরুভূমি মেরুভূমি পরস্পর ইশারায় ডাকে
শোনো, বুকের অলিন্দে গিয়ে শোনো
হে নিবিড় মায়াবিনী, ঝলমলে আঙুল তুলে দাও।
কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা
চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে
কাছাকাছি আনো
নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!


এই দৃশ্য
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

হাঁটুর ওপরে থতনি, তুমি বসে আছো
নীল ডুরে শাড়ী, স্বপ্নে পিঠের ওপরে চুল খোলা
বাতাসে অসংখ্য প্রজাপতি কিংবা সবই অভ্রফুল?
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
চোখ দুটি বিখ্যাত সুদূর, পায়ের আঙুলে লাল আভা।
ডান হতে, তর্জনিতে সামান্য কালির দাগ
একটু আগেই লিখছিলে
বাতাসে সুগন্ধ, কোথা যেন শুরু হলো সন্ধ্যারতি
অন্যদেশ থেকে আসে রাত্রি, আজ কিছু দেরি হবে
হাঁটুর ওপরে থুথনি, তুমি বসে আছো
শিল্পের শিরায় আসে উত্তেজনা, শিল্পের দু’চোখে
পোড়ে বাজি
মোহময় মিথ্যেগুলি চঞ্চল দৃষ্টির মতো, জোনাকির মতো উড়ে যায়
কোনোদিন দুঃখ ছিল, সেই কথা মনেও পড়ে না
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
সময় থামে না জানি, একদিন তুমি আমি সময়ে জড়াবো
সময় থামে না, একদিন মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে
দিগন্ত পেরিয়ে-
নতুন মানুষ এসে গড়ে দেবে নতুন সমাজ
নতুন বাতাস এসে মুছে দেবে পুরোনো নি:শ্বাস,
তবু আজ
হাঁটুর ওপরে থুতনি,তুমি বসে আছো
এই বসে থাকা, এই পেঠের ওপরে খোলা চুল,
আঙুলে কালির দাগ
এই দৃশ্য চিরকাল, এর সঙ্গে অমরতা সখ্য করে নেবে
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো…


স্মৃতির শহর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মধ্যরাত্রির খটখটে জেগে ওঠার মধ্যে তোমার স্বপ্ন দেখি
হে গাঢ় নীল জ্যোৎস্নার মতন বিচ্ছেদ-বেদনা
হে বরাকর বাংলোর মতন ঝুকে পড়া অপরাহ্ণ
হে প্রচ্ছন্ন অভিমান!
মনে পড়ে ওভাররীজের উপর দাড়িয়ে হলুদ হাতছানি
দেবী স্বরসতীর স্তনের মতন রাংগা-রাঙ্গা চাঁদ
একটি টিট্টিভের ডাক
দেবদারু পাতার সরসর শব্দে জেগে ওঠে যৌবনের একটি দিন
একটি বৃন্তচ্যুত অনিত্য
কলেজ-পালানো কিছু ভালো না লাগা রাস্তা
আমায় নিয়ে যায় ছন্নছাড়া দেশে
যেখানে হঠাত ঝলসে ওঠে অলৌকিক বাস্তব
দিগন্তে পাহাড় মেলে দিয়েছে তার ঐশ্বর্যময়ী উরু
বুক জ্বালা নেশা নয়, এমনই একাকীত্ব
লন্ঠন দুলিয়ে দুলিয়ে একজন কেউ চলে যায়,
সে আর ফিরবেনা ।
কালোর হৃদয় চেরা কালো, তারও ভেতরের নিবিড় সরল কালো
অবিকল একটি শিশুর মতন
লাফিয়ে পড়ে নদীর জলে
সে আমার বাতাসে উদাস করা মন খারাপ ।
সমস্ত নির্জনতার ভেতর থেকে ঐরাবতের মতন উঠে আসে
আমার পরাজয়
হে আমার দিগন্ত কুন্তলা মৃত্যু, হে ভোগবতী
সেই টিলার শিয়রে স্বন্ধ্যায় সর্বাঙ্গে বৃষ্টির মতন শিহরণ
বড় প্রিয়, যেন শুধু চোখে চোখ রাখা
জেগে উঠি মধ্যরাত্রে, যাকে না-দেখার
তাকে স্বপ্ন দেখি ।


প্রতীক্ষায়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

গোলাপে রয়েছে আঁচ, পতঙ্গের ডানা পুড়ে যায়
হাওয়া ঘোরে দূরে-দূরে
ফুলকে সমীহ করে
সূর্যাস্তও থমকে থাকে!
দেখো-দেখো
আমার বাগানে এক অগ্নিময় ফুল ফুটে আছে
তার সৌরভেও কত তাপ!
আর সব কুসুমের জীবন-চরিত তুচ্ছ করে
সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে চতুর্দিক
বৈদুর্ষমণির মতো চোখ মেলে সে রয়েছে প্রতীক্ষায়
কার? কার?


প্রতীক জীবন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রতীকের মুরুভূমি পায় না কখনো মরূদ্যান
যেমন নারীর নেই আঙুলের ব্যথা কবিতায়
আমার সমুদ্র নেই বিছানা, শিয়রের কাছে
শান্ত মেঘ
কবিতায় আছে।
বিংশ শতাব্দরি ঠিক মাঝামাঝি ভেঙেছিল ঘুম
গ্রাম্য সোঁদা গন্ধ-মাখা ক্ষ্যাপাটে কৈশোর
কেটেছে বাসনা-ক্ষুব্ধ মুখ চোরা দিন, প্রতিদিন
অথচ অক্ষরে, শব্দে, ছন্দ-মিলে তীব্র প্রতিশোধ
না-পাওয়া নারীর রূপে অবগাহনের উম্মত্ততা
প্রতীক জীবন, নেই মরূদ্যান, জ্যোৎস্নার সমুদ্র, নেই
শিয়রের কাছে শান্ত মেঘ-
কবিতায় আছে।


সত্যবদ্ধ অভিমান
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে
ভীষণ জরুরী কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
যেন মায়াপাশ সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর
কোনো মিথ্যে কি মানায় ?


স্থির সত্য
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বহুদিন আকাশ ভাসানো জ্যোৎস্নায়
হেঁটে যাইনি
নদীর কিনারায়
একটি ঘাসফুল ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দেইনি স্রোতে
বহুদিন, বহুদিন-
তবু আমি জানি
এখনো কোনোদিন জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় আকাশ
আমার জন্য প্রতীক্ষা করে
নদীর কিনারার মাটি প্রতীক্ষা করে আছে
আমার পদস্পর্শের
ঘাসফুলটি হাওয়ায় দুলছে প্রতীক্ষায়
আমি তাকে ছিঁড়ে নেব
জলস্রোত ছলচ্ছল শব্দে আমায় ডাক পাঠাবে
এই সব স্থির সত্য নিয়ে বেঁচে আছি ।


মানস ভ্রমণ
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন
এই পৃথিবীকে
এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে যাই দুই
পায়ে হেঁটে হেঁটে
অথবা বিমানে। কিংবা কী নেবে
লোহা শুঁয়ো পোকা?
অথবা সওদাগরের, নৌকো, যার গলুইয়ের
দু‘পাশে দু‘খানি
রঙিন চক্ষু, অথবা তীর্থ যাত্রীদলের, সার্থবাহের
সঙ্গী হবো কি?
চৌকো পাহাড়, গোল অরণ্যে মায়ার আঙুলে
হাতছানি দেয়
লাল সমুদ্র, নীল মরুভূমি, অচেনা দেশের
হলুদ আকাশ
সূর্য ও চাঁদ দিক বদলায় এন গহন
আমায় ডেকেছে
কিছু ছাড়বো না, আমি ঠিক জানি গোটা দুনিয়াটা
আমার মথুরা
জলের লেখায় আমি লিখে যাবো এই গ্রন’টির
তন্নতন্ন
মানস ভ্রমণ।


একবার এ জীবনে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুখের তৃতীয় সিঁড়ি ডানপাশে
তার ওপাশে মাধুর্যের ঘোরানো বারান্দা
স্পষ্ট দেখা যায়, এই তো কতটুকুই বা দূরত্ব
যাও, চলে যাও সোজা!
সামনের চাতালটি বড় মনোরম, যেন খুব চেনা
পিতৃপরিচয় নেই, তবু বংশ-মহিমায় গরীয়ান
একটা বাড় গাছ, অনেক পুরোনো
তার নিচে শৈশবের, যৌবনেরর মানত-পুতুল
এত ছায়াময় এই জায়গাটা, যেন ভুলে যাওয়া স্নেহ
ভুল নয়, ছায়া তো রয়েছে।
সদর দরজাটি একেবারে হাট করে রাখা
বড় বেশি খোলা যেন হিংসের মতন নগ্ন
কিংবা জঙ্গলের ফাঁসকল
আসলে তা নয়, পূর্বপুরুষের তহীর্ঘ পরিহাস
লেহার বলটুতে এত সুন্দর সাপানো এত দৃঢ়
আর বন্ধই হয় না!
ভিতরের তেজি আলো প্রথমে যে-সিঁড়িটা দেখায়
সেটা মিথ্যে নয়, দ্বিতীয়টি অন্য শরীকের
বাকি সব দিক, বলা-ই বাহুল্য, মেঘময়।
মনে করো, মল্লিক বাড়ির মতো মৃত কোনো পথিক স’াপত্য
ভাঙা শ্বেত পাথরেরা হাসে, কাঠের ভিতরে নড়ে ঘুণ
কত রক, পরিত্যক্ত দরদালান, চামচিকের থুতু
আর কিছু ছাতা-পড়া জলচৌকি, ঐখানে
লেগে আছে যৌনতার তাপ
ঐখানে লেগে আছে বড় চেনা নশ্বরতা।
তবু সবকিছু দূরে ছোঁয়া যায় না, এমন অসি’র মনোহরণ
মধ্যরাতে ডাকে, তোমাকে, তোমাকে!
দুপুরেও আসা যায়, যদি ভাঙে মোহ
অথবা ঘুমোয় ঈর্ষা পাগলের শুদ্ধতার মতো
তখন কী শান্ত, একা, হৃদয় উতলা
হে আতুর, হে দুঃখী, তুমি এক-ছুটে চলে যাও
ঐ মাধুর্যের বারান্দায়
আর কেউ না-দেখুক, অন্তত একবার এ জীবনে।।


এখনো সময় আছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তখন তোমার বয়স আশী, দাঁড়াবে গিয়ে আয়নায়
নিজেই ভীষণ চমকে যাবে, ভাববে এ কে ? সামনে এ কোন ডাইনী ?
মাথা ভর্তি শনের নুড়ি, চামড়া যেন চোত-বোশেখের মাটি
চক্ষু দুটি মজা-পুকুর, আঙুলগুলো পাকা সজনে ডাটা !
তোমার দীর্ঘষ্বাস পড়বে, চোখের কোণে ঘোলা জলের ফোটায়
মনে পড়বে পুরনো দিন, ফিসফিসিয়ে বলবে তুমি,
আমারও রূপ ছিল !
আমার রূপের সুনাম গাইত কত শিল্পী-কবি !
তাই না শুনে পেছন থেকে তোমার বাড়ির অতি ফচকে দাসী
হেসে উঠবে ফিকফিকিয়ে
রাগে তোমার শরীর জ্বলবে ! আজকাল আর ঝি-চাকরের নেই কোন
ভব্যতা !
মুখের উপর হাসে ? এত সাহস ? তুমি গজগজিয়ে যাবে অন্য ঘরে
আবার ঠিক ফিরে আসবে, ডেকে বলবে, কেন ?
কেন রে তুই হাসিস ? তোর বিশ্বাস হলো না ?
আমারও রূপ ছিল, এবং সেই রূপ দেখে পাগল
হয়েছিলেন অনেক লোকই, এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় !
সবাই যাকে শ্রদ্ধা করে, যার কবিতা সবার ঠোটে ঠোটে
প্রতিবছএর জন্মদিনে যার নামে হয় কয়েক ঘন্টা বেতারে গান বাজনা
সেই তিনি, সেই কবি এমন বুড়ীর জন্য পাগল
হয়েছিলেন ? হি হি হি হি এবং হি হি হি হি
রাগে তোমার মুখের চামড়া হয়ে উঠবে চিংড়ি মাছের খোসা
তুমি ভাববে এক্ষুনি সুনীলকে ডেকে যদি সবার
সামনে এনে প্রমাণ করা যেত ।
কিন্তু হায়, কি করে তা হবে ?
সেই সুনীল তো মরেই ভূত পঁচিশ বছর আগে
কেওড়াতলার চুল্লীতে যার নাভীর চিহ্ন খুঁজেও পাওয়া যায়নি !

তাই তো বলি, আজও সময় আছে
এখন তুমি সাতাশ এবং সুনীলও বেশ যুবক
এখনও তার নাম হয়নি, বদনামটাই বেশি
সবাই বলে ছোকরা বড় অসহিষ্ণু এবং মতিচ্ছন্ন
লেখার হাত ছিল খানিক, কিন্তু কিছুই হলো না ।

তাই তো বলি, আজও সময় আছে
দাঁড়াও তুমি অখ্যাত বা কুখ্যাত সেই কবির সামনে
সোনার মতো তোমার ঐ হাত দু’খানি যেন ম্যাজিক দন্ড
বলা যায় না, তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে একদিন সে হতেও পারে
দ্বিতীয় রবিঠাকুর !
তোমার সব রূপ খুলে দাও, রূপের বিভায় বন্দী করো
তোমার রূপের অরূপ রঙ্গ তাকে সত্যিই পাগল করবে
তোমার চোখ, তোমার ওষ্ঠ, তোমার বুক, তোমার নাভি…
তোমার হাসি, অভিমানে গুচ্ছ গুচ্ছ অশোক পুষ্প…
কিন্তু তুমি তখনই সেই সুনীল, সেই তোমার রূপের পূজারীর
চুলের মুঠি চেপে ধরবে, বলবে , আগে লেখো !
শুধু মুখের কথায় নয়, রক্ত লেখা ভাষায়
কাব্য হোক রূপের, শ্লোক, ওমর ভালোবাসায় ।


কই, কেউ তো ছিলো না
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কেউ ভালোবেসে ভুল করে, কেউ কেউ ভালোই বাসেনা
কেউ কেউ চতুরতা দিয়ে খায় পৃথিবীকে, কেউ কেউ বেলা যায়
ফিরেও আসে না ।

ওপরে চাঁদের কাছে মেঘ জমে পাহাড়ের মেষ তৃণে আগুন
লেগেছে
যাদের বাঁচার কথা ছিল, নেই, ভুল মানুষেরা আছে বেঁচে ।

স্বপ্ন বারবার ভাঙে, তবু ফের স্বপ্ন উপাদান দেয় অচেনা নারীরা
তাদের গলায় দোলে রক্তমাখা অত্যুজ্জল ধাতুমালা, পান্না কিংবা
হীরা !

আমার যা ভালোবাসা, কাঙালের ভালোবাসা, এর কোন মূল্য
আছে নাকি ?
এ যেন জলের ঝারি, কেউ দেখা দেবে বলে হঠাৎ মিলিয়ে যায়
বাবলা কাটার ঝোপে
যেমন জোনাকী !

সুধা ভ্রমে বিষ খাই, বিষ এত মিষ্টি বুঝি ? তবে যে সকলে
বলো লোনা ?
আমাকে মৃত্যুর হাতে ফেলে ওরা চলে যায়, বারবার
ওরা মানে কারা ?
কই, কেউ তো ছিলো না !


রক্তমাখা সিড়ি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চেয়েছি নতুন দিন,
স্নানসিক্ত পৃথিবীর নতুন মহিমা
মানুষের মতো বেঁচে থাকা যেন মানুষ্য জন্মেই ঘটে যায়
বঞ্চনা শব্দটি যেন
অচেনা ভাষার মতো মূঢ় করে
এ-জীবন আনন্দের, চতুর্দিকে হাহাকার মুছে যে-রকম স্নিগ্ধ সুখ….
কখনো আনন্দ হয় ফুল ছিড়ে,
অপরের অন্ন কেড়ে নয়
চেয়েছি নতুন দিন শ্রেণীহীন, স্পর্ধাহীন, বিশুদ্ধ সমাজ
যখন মুখোশে আর
লুকোবে না মানুষের মুখ
শস্য ও বাণিজ্যে সব লোভের করাল দাঁত ভাঙা
কুটিল ও ষড়যন্ত্রী শৃঙ্খলিত, পৃথিবীর সব জননীর
বুকের শিশুরা রবে নিরাপদ;
একাকিত্বে বিংবা জনতায়
স্বপ্নের শব্দের মুক্তি-
ভালোবাসা মিশে যাবে দিগন্ত দেয়ালে
চেয়েছি নতুন দিন, গ্লানিহীন যৌবরাজ্য,
সৃষ্টিতে স্বাধীন।
চাইনি এমন গোর কালবেলা, অসহিষ্ণু অবিশ্বাস ঘৃণা
হৃৎপিন্ডে অন্ধকার
কন্ঠরুদ্ধ দিনরাত্রে এত হিংসা বিষ
প্রতীপ জ্বলার চেয়ে অগ্নিকান্ডে মুখ দেখাদেখি
চাইনি শ্মাশান-শান্তি,
চাইনি পিচ্ছিল গলিঘুঁজি
সবাই পথিক তবু কে কোথায় যাবে তা ভুলে পথে মারামারি
চাইনি অস্ত্রের রোষ,
শত্রু ভুলে নেশাগ্রস্ত মারণ উল্লাস
বিবেকের ঘরে চুরি, স্বপ্নের নতুন দিন দুলোয় বিলীন
চতুর্দিকে রক্ত, শুধু রক্ত,
আমারই বন্ধু ও ভাই ছিন্নভিন্ন
এতে কার জয়?
রক্তমাখা নেংরা এই সিঁড়ি দিয়ে আমি কোনো স্বর্গেও যাবো না।


স্থির সত্য
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বহুদিন আকাশ ভাসানো জ্যোৎস্নায়
হেঁটে যাইনি
নদীর কিনারায়
একটি ঘাসফুল ছিঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দেইনি স্রোতে
বহুদিন, বহুদিন-
তবু আমি জানি
এখনো কোনোদিন জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় আকাশ
আমার জন্য প্রতীক্ষা করে
নদীর কিনারার মাটি প্রতীক্ষা করে আছে
আমার পদস্পর্শের
ঘাসফুলটি হাওয়ায় দুলছে প্রতীক্ষায়
আমি তাকে ছিঁড়ে নেব
জলস্রোত ছলচ্ছল শব্দে আমায় ডাক পাঠাবে
এই সব স্থির সত্য নিয়ে বেঁচে আছি ।


কঙ্কাল ও শাদা বাড়ি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শাদা বাড়িটার সামনে আলো-ছায়া-আলো, একটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে
এখন দুপুর রাত অলীক রাত্রির মতো, অররণা রয়েছে খুব ঘুমে-
যে-রকম ঘুম শুধু কুমারীর, যে ঘুম স্পষ্টত খুব নীল;
যে স্তনে লগৈনি দাঁত তার খুব মৃদু ওঠপড়া
তলপেটে একটুও নেই ফাটা.দাগ, এ শরীর আজও ঋণী নয়
এই সেই অরুণা ও রুনি নাম্মী পরা ও অপরা
সুখ ও আসুখ নিয়ে ওষ্ঠাধর, এখন রয়েছে খুব ঘমে
যে-রকম ঘুম শুধু কুমারীর, যে-ঘুম স্পষ্টত খুব নীল।
সন্ন্যাসীর সাহসের মতো আন্ত অন্ধকার, কে তুমি কঙ্কাল-
প্রহরীর মতো, কেন বাধা তিদে চাও? কী তোমার ভাষা?
ছাড়ো পথ, আমি ঐ শাদা বাড়িটার মধ্যে যাবো।
করমচা ফুলেরঘ্রণ আলপিনের মতো এসে গয়ে লাগে
থামের আড়োলে থেকে ছুটে এলো হাওয়া, বহু ঘুমের নিশ্বাস
ভরা হাওয়া
আমি অরুণার ঘুমে এক ঘুম ঘুমোতে চাই আজ মধ্য রাতে
অরুণার শাড়ি ও শায়ার ঘুম, বুকে ঘুম, কুমারী জন্মের
পবিত্র নরম ঘুম, আমি ব্রাহ্মণের মতো তার প্রার্থী।
নিরস্ত্র কঙ্কাল, তুমি কার দূত? তোমার হৃদয় নেই, তুমি
প্রতীক্ষার ভঙ্গি নিয়ে কেন প্রতিরোধ করে আছো?
অরুণা ঘুমন্ত, এই শাদা বাড়িটার দ্বারে তুমি কেন জেগে?
অরুণা ঘুমন্ত, এই শাদা বাড়িটার দ্বরে তুমি কেন জেগে?
তুমি ভ্রমে বদ্ধ, তুমি ওপাশের লাল রঙা প্রাসাদের কাছে যাও
ঐখানে পাশা খেলা হয়, হু-রে-রে চিৎকরে ওঠে হৃদয়ে শকুনির
ঝটাপটি, তুমি যাও
ছাড়ো পথ, আমি এই নিদ্রিত বাড়ির মধ্যে যাবো।।


আমার গোপন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটা ভীষণ গোপন কথা
খাঁচার মধ্যে বন্দী আছে
গোপন সে তো খুবই আপন
তবু এমন ছটফটানি
যেন সকাল থেকে স্বন্ধে
সারা বিশ্ব থমকে থেকে
আমার ক্ষদ্র গোপনতার
নিশান দেখে সুনাম গাইবে ।

আমার গোপন ক্ষুদ্র ছিল
যখন তার জন্ম হয়নি
ক্রমশ তার চক্ষু ফোটে
ডানায় ফোটে স্নিগ্ধ বাতাস
খাচায় আর ধরা যায়না
রঙ্গিন জামার মধ্যে লুকোয়
শরীর দিয়ে খুজোখুজির
শেষেও তার শেষ মেলে না
আমার গোপন রাত্রিকালের
জ্যোৎস্না হয়ে লুটিয়ে থাকে ।


আত্মা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গে আমার চতুর্থভাগ আত্মা ছুটে যায়
প্রতিটি আত্মার সঙ্গে আমার নিজেস্ব ট্রেন অসময় নিয়ে
খেলা করে।
আলোর দোকানে আমি হাজার হাজার বাতি সজিয়ে রেখেছি
নষ্ট-আলো সঞ্জীবনী শিক্ষা করে আমার চঞ্চল
অহমিকা।
জাদুঘরে অসংখ্য ঘড়িতে আমি অসংখ্য সময় লিখে রাখি
নারীর ঊরুর কাছে আমার পিঁপড়ে দূত ঘোরে ফেরে
আমারই ইঙ্গিতে তারা চুম্বনের আগে
কেঁপে ওঠে।
এইরূপ কর্মব্যস্ত জীবনের ভিতরে-বাইরে ডুবে থেকে
বিকেলের অমসৃণ বাতাসে হঠাৎ আমি দেখি
আমার আত্মার একাটা কুচো টুকরো
আজও কোনো কাজ পায়নি।।


দুটি অভিশাপ
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
প্রবল ঢেউ-এর মাথায় ফেনার মধ্যে
মিশে গিয়েছিল আমার থুতু
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
সমুদ্রের অভিশাপ।
মেল ট্রেনের গায়ে আমি খড়ি দিয়ে এঁকেছিলাম
নারীর মুখ
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
এমনকি, সেই নারীরও চোখের তারা আঁকা ছিল না
এক স্টেশন পার হবার আগেই বৃষ্টি, প্রবল বৃষ্টি
হয়তো বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছিল আমার খড়ির শিল্প
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
মেল ট্রেনের অভিশাপ।
প্রতিদিন পথ চলা কি পথের বুকে পদাঘাত?
নারীর বুকে দাঁত বসানো কি শারীরিক আক্রমণ?
শীতের সকালে খেঁজুর-রস খেতে ভালো-লাগা
কি শোষক সমাজের প্রতিনিধি হওয়া?
প্রথম শৈশবে সরস্বতী-মূর্তিকে আলিঙ্গন করা কি পাপ?
এ-সব বিষয়ে আমি মনসি’র করতে পারিনি
কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পাই
সমুদ্র ও মেল ট্রেনের অভিশাপ।


শুভ জন্মদিন হে চিরকিশোর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দ’দিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়-
বয়ষ্করা এমনই উন্মাদ ।
তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি !
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই ?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে !
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই ।


চায়ের দোকানে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,
রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস
দীপু তো শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল
এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ
তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক;
আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল
সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!
কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ
সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে –
এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ
দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ?
গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম
এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই
আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।


নীরা তুমি কালের মন্দিরে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
খুঁজে পাবো?
অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায়
মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত
দিতে পারি, অনেক সহজ
কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে
যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে
ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর
জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর
তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা
জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ
নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়!


কথা আছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি,
টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি,
ওপাশে শাড়ির পাড়ে দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ,
দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ,
একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের
কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।


পরমা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বারেবারে চমকে উঠি, সে আসেনি ; গোধূলির আলো
পশ্চিমে তির্যক হয়ে দেবদারু চুড়ায় দাড়ালো ।
মন যদি নিভে যায় তবুও গভীরে
রত্নের স্বন্ধানী চোখ বারে বারে আসে ঘুরে ফিরে
খুঁজে পায় টুকরো, ভাঙা, শৈশব সুদূর ;
আহত পাখির মতো শুন্যে কাঁপে যন্ত্রণার সুর ।
নিজের দু’চোখে যদি মুকুরের রূপ মনে আসে
তবে কার শান্ত ছবি, কার অত;আন্ত প্রেম ভাসে ?
নিশ্বাসে স্মৃতির সঙ্গ চেতনার দিগন্তে ছড়ালো
বারেবারে চমকে উঠি, কে এসেছে, গোধুলির আলো ।


সে কোথায়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বালির ওপরে কার তাজা রক্ত ? এদিকে ওদিকে
চেয়ে দেখি
কোনো হিংস্র পশু বুঝি বিদ্যুৎ চমকে এসেছিল ?
বাতাসে নিষ্পাপ গন্ধ, কেউ নেই, সমস্ত শব্দও
চুপ করে আছে
উড়ন্ত আঁচল যেন নদীটির ঢেউ,
হালকা মেঘের ছায়া
ঈষৎ কিনারে এসে পা ডুবিয়ে আমি
হেট মুখে স্থির চেয়ে থাকি
বালির ওপরে কার তাজা রক্ত ? এই ছায়াময় দিনে
লুকিয়ে রয়েছে কোন হত্যাকারী ? সে কোথায় ?


মন ভাল নেই
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমন কি সুরা এমন কি ভাষা
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কি আছে অথবা কি ছিল
আমার কি আছে অথবা কি ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
আশায় আশায়…


সত্যবদ্ধ অভিমান
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে
ভীষণ জরুরী কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
যেন মায়াপাশ সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর
কোনো মিথ্যে কি মানায় ?


এসো চোখে চোখে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভালোবাসা গেছে সুদূর মানসহ্রদে
ভালোবাসা গেছে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পাহাড়ে
ভালোবাসা গেছে বৈশাখী রাতে নীরব নিথর জলে
ভালোবাসা যায় ছায়ার অন্বেষনে ।
ভালোবাসা বড় ব্যস্ত ভ্রমণকারী
পায়ের তলায় চাকা, দুটি হাত ডানা
চোখের নিমিষে চোখের আড়াল
হঠাৎ ছদ্মবেশী
শরীর ছড়িয়ে উঠে যেতে চায় শূণ্যে !
ভালোবাসা, তুমি এসো এই শিলাসনে
মাথার উপরে পারিজাত রুপছায়া
এখানে ঈর্ষা, মান-অভিমান আজও পথ খুঁজে পায়নি
এসো চোখে চোখে শেষতম কথা বলি !


দুঃখ
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একসময় আমি দুঃখের কথা দুঃখের সুরে বলতাম
তখন দুঃখকে চিনতামনা
কিংবা দুঃখ ছিলনা তখন, আকস্মিক
বৃষ্টিতে দুলত বিষাদের পাতলা পর্দা
পৌণে তিনশো মাইল দূরে ছুটে গেছে দীর্ঘশ্বাস
অসংখ্য নীলখাম জঠরে নিয়ে গেছে
দুপুরবেলার অভিমান
ছেড়া চটি পায়ে দিনরাত ঘুরে ঘুরে ,
সঙ্গে বহন করতাম খালি প্যাকেটের মতন
খুনখারাপ
হীরন্ময় ভোরবেলাগুলি গায়ে লেগে থাকত
হৃদয়-শোণিত
সুখী ছিলাম, সুখী ছিলাম, ভীষণ সুখী ছিলামনা?
এখন কেউ এসে দেখুক
আমার পরিচ্ছন্ন মুখ, আমার মসৃণ জীবনযাপন
চায়ের কাপের পাশে সিগারেট সমৃদ্ধ হাত
নিশীথ যুবনিকা তছনছ করা সৌখিন দাপাদাপি
যে-কেউ দেখে ভাববে আমি দুঃখকে চিনিইনা……


দুপুর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোরই শস্য, দুপুরের অস্থির কুহক
অলিন্দে দাঁড়ানো মূর্তি ঢেকে দিল দু’চক্ষুর সীমা
পথ চলতে থম্কে গেলো অপ্রতিভ অসংখ্য যুবক।
ভিজে চুল খুলেছে সে সুকুমার, উদাস আঙুলে
স্তনের বৃন্তের কাছে উদ্বেলিত গ্রীষ্মের বাতাস
কি যেন দেখলো মিলে এক সঙ্গে নিল দীর্ঘশ্বাস।

একজন যুবক শুধু দূর থেকে হেঁটে এসে ক্লান্ত রুক্ষ দেহে
সিগারেট ঠোঁটে চেপে শব্দ করে বারুদ পোড়ালো
সম্বল সামান্য মুদ্রা করতলে গুণে গুণে দেখলো সস্নেহে
এ মাসেই চাকবি হবে, হেসে উঠলো, চোখে পড়লো
অলিন্দের আলো।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, নির্লিপ্তের মতো চেয়ে বললো মনে মনে
কিছুদূর হেঁটে গিয়ে শেষবার ফিরে দেখলো তাকে
রোদ্দুর লেগেছে তার ঢেকে রাখা যৌবনের প্রতি কোণে কোণে
এ যেন নদীর মতো, নতুন দৃশ্যের শোভা প্রতি বাঁকে বাঁকে।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, যুবকটি মনে মনে বললো বারবার
রোদ্দুর মহৎ করে মন, আমি চাই শুধু ক্লান্ত অন্ধকার।।


ভালবাসি, ভালবাসি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,রাত জেগে পড়ার
টেবিলে বসে আছ,
ঘুম আসছে না তোমার
হঠাত করে ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি বললাম-
ভালবাস? তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো ক্লান্ত তুমি, অফিস থেকে সবে ফিরেছ,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত..
খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই,
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘর্মাক্ত আমি তোমার
হাত ধরে যদি বলি- ভালবাস?
তুমি কি বিরক্ত হবে?
নাকি আমার হাতে আরেকটু
চাপ দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম শশব্যস্ত
হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে,মাথার উপর
তপ্ত রোদ,বাহন
পাওয়া যাচ্ছেনা এমন সময় হঠাত দাঁড়িয়ে পথ
রোধ করে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার দিকে তাকিয়ে কাঁধে হাত
দিয়ে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো শেভ করছ তুমি,গাল কেটে রক্ত পড়ছে,এমন সময়
তোমার এক ফোঁটা রক্ত হাতে নিয়ে যদি বলি-
ভালবাস?
তুমি কি বকা দেবে?
নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত আমার
গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল
গলায় বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো খুব অসুস্থ তুমি,জ্বরে কপাল পুড়ে যায়,
মুখে নেই রুচি, নেই কথা বলার
অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে তোমার
মুখের
দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাস?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?নাকি তোমার গরম
শ্বাস আমার
শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,প্রচন্ড
যুদ্ধে তুমিও অঃশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাস? ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও?
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস
দেবে,বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ
তুমি,দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরুতে যাবে,হঠাত
বাধা দিয়ে বললাম-ভালবাস? কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত
বুলাতে বুলাতে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি
ধরো প্রচন্ড ঝড়,উড়ে গেছে ঘরবাড়ি,আশ্রয় নেই
বিধাতার দান এই
পৃথিবীতে,বাস করছি দুজনে চিন্তিত তুমি
এমন সময় তোমার
বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালবাস?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে
ভালবাসি, ভালবাসি..
ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-ভালবাস?
চুপ করে থাকবে?নাকি সেখান থেকেই
আমাকে বলবে ভালবাসি, ভালবাসি..
যেখানেই যাও,যেভাবেই থাক,না থাকলেও দূর
থেকে ধ্বনি তুলো
ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি..
দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর,বুঝব
তুমি আছ,তুমি আছ
ভালবাসি, ভালবাসি….


দেখা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভালো আছো?
– দেখো মেঘ বৃষ্টি আসবে।
ভালো আছো?
– দেখো ঈশান কোনের আলো, শুনতে পাচ্ছো ঝড়?
ভালো আছো?
-এইমাত্র চমকে উঠলো ধপধপে বিদ্যুৎ ।
ভালো আছো?
– তুমি প্রকৃতিকে দেখো।
– তুমি প্রকৃতি আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছো।
আমিতো অণুর অণু, সামান্যর চেয়েও সামান্য।
তুমি জ্বালাও অগ্নি, তোল ঝড়, রক্তে এতো উন্মাদনা।
– দেখো সত্যিকার বৃষ্টি, দেখো সত্যিকার ঝড়।
তোমাকে দেখাই আজোশেষ হয়নি,
তুমি ভালো আছো


চে গুয়েভারার প্রতি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!


নশ্বর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কখনো কখনো মনে হয়, নীরা, তুমি আমার
জন্মদিনের চেয়েও দূরে
তুমি ঝরাপাতা অরণ্যে হেঁটে চলো
তোমার মসৃণ পায়ের নিচে পাতা ভাংগার শব্দ
দিগন্তের কাছে মিশে আছে মোষের পিঠের মতন
পাহাড়
জয়ডঙ্কা বাজিয়ে তাঁর আড়ালে ডুবে গেল সূর্য
এসবই আমার জন্মদিনের চেয়েও দূরের মনে হয় ।

কখনো কখনো আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়ে
নক্ষত্রের মৃত্যু
মনের মধ্যে একটা শিহরণ হয়
চোখ নেমে আসে ভূ-প্রকৃতির কাছে ;
সেই সব মূহুর্তে, নীরা, মনে হয়
নইশ্বরতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নেমে পড়ি
তোমার বাদামী মুষ্টিতে গুঁজে দিই স্বর্গের পতাকা
পৃথিবীময় ঘোষণা করে দিই, তোমার চিবুকে
ঐ অলৌকিক আলো
চিরকাল থমকে থাকবে !
তখন বহুদূর পাতা-ঝরা অরণ্যে দেখতে পাই
তোমার রহস্যময় হাসি-
তুমি জানো, স্বন্ধেবেলার আকাশে খেলা করে সাদা পায়রা
তারাও অন্ধকারে মুছে যায়, যেমন চোখের জ্যোতি-এবং পৃথিবীতে
এত দুঃখ
মানুষের দুঃখই শুধু তাঁর জন্মকালও ছাড়িয়ে যায় ।


ছায়া
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

হিরন্ময়, তুমি নীরার মুখোমুখি দাড়িয়ো না,
আমি পছন্দ করিনা
পাশে দাঁড়িয়ো না, আমি পছন্দ করিনা
তুমি নীরার ছায়াকে আদর করো।
হিরন্ময়, তোমার দিব্য বিভা নেই, জামায় একটা
বোতাম নেই, ছুরিতে হাতল নেই,
শরীরে এত ঘাম, রক্তে এত হর্ষ,
চোখে অস্থিরতা
এ কোন ঘাতকের বেশে তুমি দাড়িয়েছো ?
ঘাতক হওয়া তোমাকে মানায় না
তুমি বরং প্রেমিক হও
সামনে দাঁড়িয়ো না, পাশে এসো না
তুমি নীরার ছায়ায় মুখ চুম্বন করো ।

কই, কেউ তো ছিলো না
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কেউ ভালোবেসে ভুল করে, কেউ কেউ ভালোই বাসেনা
কেউ কেউ চতুরতা দিয়ে খায় পৃথিবীকে, কেউ কেউ বেলা যায়
ফিরেও আসে না ।

ওপরে চাঁদের কাছে মেঘ জমে পাহাড়ের মেষ তৃণে আগুন
লেগেছে
যাদের বাঁচার কথা ছিল, নেই, ভুল মানুষেরা আছে বেঁচে ।

স্বপ্ন বারবার ভাঙে, তবু ফের স্বপ্ন উপাদান দেয় অচেনা নারীরা
তাদের গলায় দোলে রক্তমাখা অত্যুজ্জল ধাতুমালা, পান্না কিংবা
হীরা !

আমার যা ভালোবাসা, কাঙালের ভালোবাসা, এর কোন মূল্য
আছে নাকি ?
এ যেন জলের ঝারি, কেউ দেখা দেবে বলে হঠাৎ মিলিয়ে যায়
বাবলা কাটার ঝোপে
যেমন জোনাকী !

সুধা ভ্রমে বিষ খাই, বিষ এত মিষ্টি বুঝি ? তবে যে সকলে
বলো লোনা ?
আমাকে মৃত্যুর হাতে ফেলে ওরা চলে যায়, বারবার
ওরা মানে কারা ?
কই, কেউ তো ছিলো না !


এখনো সময় আছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তখন তোমার বয়স আশী, দাঁড়াবে গিয়ে আয়নায়
নিজেই ভীষণ চমকে যাবে, ভাববে এ কে ? সামনে এ কোন ডাইনী ?
মাথা ভর্তি শনের নুড়ি, চামড়া যেন চোত-বোশেখের মাটি
চক্ষু দুটি মজা-পুকুর, আঙুলগুলো পাকা সজনে ডাটা !
তোমার দীর্ঘষ্বাস পড়বে, চোখের কোণে ঘোলা জলের ফোটায়
মনে পড়বে পুরনো দিন, ফিসফিসিয়ে বলবে তুমি,
আমারও রূপ ছিল !
আমার রূপের সুনাম গাইত কত শিল্পী-কবি !
তাই না শুনে পেছন থেকে তোমার বাড়ির অতি ফচকে দাসী
হেসে উঠবে ফিকফিকিয়ে
রাগে তোমার শরীর জ্বলবে ! আজকাল আর ঝি-চাকরের নেই কোন
ভব্যতা !
মুখের উপর হাসে ? এত সাহস ? তুমি গজগজিয়ে যাবে অন্য ঘরে
আবার ঠিক ফিরে আসবে, ডেকে বলবে, কেন ?
কেন রে তুই হাসিস ? তোর বিশ্বাস হলো না ?
আমারও রূপ ছিল, এবং সেই রূপ দেখে পাগল
হয়েছিলেন অনেক লোকই, এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় !
সবাই যাকে শ্রদ্ধা করে, যার কবিতা সবার ঠোটে ঠোটে
প্রতিবছএর জন্মদিনে যার নামে হয় কয়েক ঘন্টা বেতারে গান বাজনা
সেই তিনি, সেই কবি এমন বুড়ীর জন্য পাগল
হয়েছিলেন ? হি হি হি হি এবং হি হি হি হি
রাগে তোমার মুখের চামড়া হয়ে উঠবে চিংড়ি মাছের খোসা
তুমি ভাববে এক্ষুনি সুনীলকে ডেকে যদি সবার
সামনে এনে প্রমাণ করা যেত ।
কিন্তু হায়, কি করে তা হবে ?
সেই সুনীল তো মরেই ভূত পঁচিশ বছর আগে
কেওড়াতলার চুল্লীতে যার নাভীর চিহ্ন খুঁজেও পাওয়া যায়নি !

তাই তো বলি, আজও সময় আছে
এখন তুমি সাতাশ এবং সুনীলও বেশ যুবক
এখনও তার নাম হয়নি, বদনামটাই বেশি
সবাই বলে ছোকরা বড় অসহিষ্ণু এবং মতিচ্ছন্ন
লেখার হাত ছিল খানিক, কিন্তু কিছুই হলো না ।

তাই তো বলি, আজও সময় আছে
দাঁড়াও তুমি অখ্যাত বা কুখ্যাত সেই কবির সামনে
সোনার মতো তোমার ঐ হাত দু’খানি যেন ম্যাজিক দন্ড
বলা যায় না, তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে একদিন সে হতেও পারে
দ্বিতীয় রবিঠাকুর !
তোমার সব রূপ খুলে দাও, রূপের বিভায় বন্দী করো
তোমার রূপের অরূপ রঙ্গ তাকে সত্যিই পাগল করবে
তোমার চোখ, তোমার ওষ্ঠ, তোমার বুক, তোমার নাভি…
তোমার হাসি, অভিমানে গুচ্ছ গুচ্ছ অশোক পুষ্প…
কিন্তু তুমি তখনই সেই সুনীল, সেই তোমার রূপের পূজারীর
চুলের মুঠি চেপে ধরবে, বলবে , আগে লেখো !
শুধু মুখের কথায় নয়, রক্ত লেখা ভাষায়
কাব্য হোক রূপের, শ্লোক, ওমর ভালোবাসায় ।


মুক্তি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একজন মানুষ মুক্তিফল আনতে গিয়েছিল,
সে বলেছিল, আমি ফিরে আসবো
প্রতীক্ষায় থেকো।
জানিনা সে কোথায় গেছে
কোন হিম নিঃসংগ অরণ্যে
বা কোন নীলিমাভুক পাহাড় চুড়ায়
জানিনা তার সামনে কত দুস্তর বাধা
জানিনা সে সংগ্রাম করছে কোন
অসহনীয়ের সঙ্গে।
সে মুক্তিফল আনবে বলেছিল
সে বলেছিল প্রতীক্ষায় থাকতে
আমি দ্বাদশ বৎসর থাকবো তার জন্য পথ চেয়ে
তারপরেও সে না ফিরলে
আমাকে যেতে হবে……
আমিও না ফিরলে যাবে আমার সন্তান-সন্ততিরা


বহুদিন পর প্রেমের কবিতা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বুকের ভিতরে যেন মুচড়ে উঠলো একুশে এপ্রিল
একুশে এপ্রিল, ওকি চুলের ভিতরে কার ক্ষীণ বজ্রমুষ্টি?
বিষম লোভের মধ্যে ছুটোছুটি – দূর শহর, অব্যক্ত মন্দিরে
ব্রীজের অনেক নীচে চাঁদ, আঃ সহ্য হয় না এমন জ্যোৎস্নায়
জলের বিমর্ষ শব্দ, এক আনার টিকিট পেরিয়ে
ওপারে পৌঁছুলে ট্রেন, স্টেশনের একুশে এপ্রিল
রাত্রি দিয়েছিল।
চোরকাঁটা ভরা মাঠে মরা সাপ, যেও না ডিয়ার
আর ও দিকে, দূরে কাছে কোথাও বা অপর সাপের
অসহবাসের কষ্ট অতি বিষ হয়ে আছে, আমি
মেয়েসাপ বড় ঘৃণা করি….এত চাঁপা ফুল কোথায় ফুটেছে
এমন সতেজ গন্ধ….অথবা কি বী-হাইভ ব্রাণ্ডির?
কখন খেয়েছো? অঃ! হোল্ড মি টাইট, আঃ, এমন ধারালো
নোখ রেখোনা, উঁ, আঁ হুঁ হুঁ উঁ, আঃ, আঃ, আ-
বিষ নেই আমার ঠোঁটে বা জিভে বিষ নেই, মৃত্যু নেই, আ
হোল্ড মি টাইট ডিয়ার, … আমার শরীর নেই কাকে ধরবে, আ-
বিষ দিও না ঠোঁটে, প্লিজ, জরায়ুর মধ্যে একটা বিষপিণ্ড দিও না
আ-উঁ, হুঁ, হুঁ, উঃ, লাগে, লাগে আঃ আরো মারো; আমাকে
নিষ্ঠুর ভাবে মারো!
কে ছিল তোমার সঙ্গে মা শেরি, কে ছিল সেই একুশে এপ্রিল?
ইংরেজি সোহাগ বাক্য কে বলেছে? অত ভয়ঙ্কর জ্যোঃস্নারাতে
মানুষ বিষম অন্ধকার হয়
চোখ মুখ চেনা যায়না, ভিজে ঘাসে শরীরে শরীর…
আ আম সিনা, সিনা দা পোয়েট, কে তোমায় বলেছিল ফিসফিসিয়ে, আমি?
দেখো এই করতল, অবিশ্বাস কত রুক্ষ, এই চোখ দেখে বোঝা যায়
কতদিন পলক ফেলেনি, কলকাতা শহরে কোনো কবি নেই, সবাই পুলিশ
তাই ট্রাফিকের এত গণ্ডগোল, লণ্ঠন জ্বালার চেয়ে অগ্নিকাণ্ডে কতটা সুবিধে
সকলেই জেনে গেছে,…আমার মাথায় শীত, মাংসের বাজারে
ভয়াবহ নামডাক, সরলতা ছিল সেই সন্ধেবেলা, আজ
আমাকে আবার তুমি ডাক দেবে? কোথায় নদীর সেই ছলচ্ছল শব্দ, দূরে
বিষণ্ণ মাল্লার গান-সেদিনের কথা ভেবে কেন আজ খুশির বদলে
বুক ভরে কুয়াশায়, চোখ জ্বালা করে ওঠে, যেন একজীবন
গাছের ছায়ায় একা বসে আছি, কোনোদিন নারীর হৃদয়ে
হেলাইনি মাথা, বিস্মরণে এত কৃতঘ্নতা,
এবার ফিরিয়ে নাও একুশে এপ্রিল!
এবার ফিরিয়ে দেবো একুশে এপ্রিল আমি, ও মুকুট আমায় মানায় না।


নিজের আড়ালে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখ না
সে খোজে ভ্রমর কিংবা
দিগন্তের মেঘের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
কতকাল দেখা না আকাশ
কতকাল নদী বা ঝর্ণায় আর
দেখে না নিজের মুখ
আবর্জনা, আসবাবে বন্দী হয়ে যায়
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
রমণীর কাছে গিয়ে
বারবার হয়েছে কাঙ্গাল
যেমন বাতাসে থাকে সুগন্ধের ঋণ
বহু দূরের স্মৃতি আবার কখন মুছে যায়
অসম্ভব অভিমানে খুন করে পরমা নারীকে
অথবা সে অস্ত্র তোলে নিজেরই বুকের দিকে
ঠিক যেন জন্মান্ধ তখন
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে


বিবৃতি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ঊনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উন্‌তিরিশে এসে
গর্ভবতী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ
কাঁপালো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতারে কুটিল সন্দেহ
সমস্ত শরীরে মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্ত অবশেষে
যন্ত্রনার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক।
দিবাসার্ধ পায়ে হেঁটে লিরি আমি জীবিকার দাসত্ব-ভিখারী
ক্লান্ত লাগে সারারাত, ক্লান্তি যেন অন্ধকার নারী।
একদা অসহ্য হলে বাহুর বন্ধনে পড়ে ধরা
যন্ত্রনায় জর্জরিতা দুঃখিনী সে আলোর স্বরূপে
মাংসের শরীর তার শুভক্ষণে সব ক্লান্তিহরা
মন্ডুকের মতো আমি মগ্ন হই সে কন্দর্প-কূপে।
তার সব ব্যর্থ হলো, দীর্ঘশ্বাসে ভরালো পৃথিবী
যদিও নিয়মনিষ্ঠা, স্বামী নামে স্বল্প চেনা লোকটির ছবি
শিয়রেতে ত্রুটিহীন, তবু তার দুই শঙ্খ স্তনে
পূজার বন্দনা বাজে আ-দিগন্ত রাত্রির নির্জনে।
সে তার শরীর থেকে ঝরিয়েছে কান্নার সাগর
আমার নির্মম হাতে সঁপেছে বুকের উপকূল,
তারপর শান্ত হলে সুখে-দুঃখে কামনার ঝড়
গর্ভের প্রাণের বৃন্তে ফুটে উঠলো সর্বনাশ-ফুল।
বাঁচাতে পারবে না তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বীরসিংহ শিশু
হবিষ্যান্নপুষ্ট দেহ ভবিষ্যের ভারে হলো মরণসম্ভবা
আফিম, ঘুমের দ্রব্য, বেছে নেবে আগুন, অথবা
দোষ নেই দায়ে পড়ে যদি-বা ভজনা করে যীশু।।


ব্যর্থ প্রেম
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই

সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের সাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন

আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে

আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে

আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।


এক জীবন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শামুকের মতো আমি ঘরবাড়ি পিঠে নিয়ে ঘুরি
এই দুনিয়ায় আমি পেয়ে গেছি অনন্ত আশ্রয়
এই রৌদ্র বৃষ্টি, এই শতদল বৃক্ষের সংসার
অস্থায়ী উনুন, খুদ কুঁড়ো-
আবার বাতাসে ওড়ে ছাই
আমি চলে যাই দূরে, আমি তো যাবোই,
জন্ম-মৃত্যু ছাড়া আমি কোনো সীমানা মেনেছি ?
এ আকাশ আমারই নিজস্ব
আমার ইচ্ছেয় হয় তুঁতে
নারী ও নদীরা সব আমারই নিলয়ে এসে
পা ছড়িয়ে স্মৃতিকথা বলে
চমৎকার গোপান আরামে কাটে দিন
আর সব রাত্রিগুলি নিশীথ কুসুম হয়ে ঝরে যায়…


যা চেয়েছি যা পাবো না
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যা চেয়েছি, যা পাবো না
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো
দূরবর্তী নৌকো
চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-মনে হয় তুমি দেবী…
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে
তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে-
কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন
শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন
কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে
তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি
ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ?
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ…
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু’হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে–
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু’চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?


জাগরণ হেমবর্ণ
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও
আরও কাছে যাও
ও কেন হিংসার মতো শুয়ে আছে যাখন পৃথিবী খুব
শৈশবের মতো প্রিয় হলো
জল কনা- মেশা হওয়া এখন এ আশ্বিনের প্রথম সোপানে
বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়
আরও কাছে যাও
জাগরণে হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।
মধু-বিহ্বলেরা কাল রাত্রিকে খেলার মাঠ করেছিল
ঘাসের শিশিরে তার খণ্ডচিহ্ন
ট্রেনের শব্দের মতো দিন এলে সব মুছে যায়
নিথর আলো মধ্যে
চমশা-পরা গয়লানী হাই তোলে দুধের গুমটিতে
নিথর আলোর মধ্যে
কাক শালিকের চক্ষু শান
রোদ্দুরের বেলা বাড়ে, এত স্বচ্ছ
নিজেকে দেখে না
আর খেলা নেই
ও কেন স্বপ্নের মধ্যে রয়ে যায়
শরীরে বৃষ্টির মতো মোহ
আরও কাছে যাও
জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।।


তমসার তীরে নগ্ন শরীরে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চিত্ত উতলা দশদিকে মেলা সহস্র চোখ
আমাকে এবার ফিরিয়ে নেবার জন্য এসেছে?
আর দুটো দিন করুণ রঙিন
পথ ঘুরে দেখা
হবে না আমার? পুরোনো জামার ছিঁড়েছে বোতাম?
তমসার তীরে নগ্ন শরীরে
দাঁড়ালাম আমি
পাশে নেই আর মায়া-সংসার আকাশে অশনি
নদীটি এখন বড় নির্জন
জলে শীত ছোঁওয়া
কে জানে কোথায় ন্যায়-অন্যায় সহসা লুকালো
এক অঞ্জলি জল তুলে বলি,
হে আঁধারবতী,
বহু ঘুরে-ঘুরে স্বপ্নে সুদূরে দেখা হয়েছিল
দুঃখ ক্ষুধায় এই বসুধায়
হয়েছি হন্যে
কখনো দাওনি সুধার চাহনি ফিরিয়েছো মুখ!
মনে আছে সব? শেষ উঃসব
আজ শুরু হবে
মেশাবো এ জলে মন্ত্রের ছলে অতি প্রতিশোধ
শরীর জানে না কে কার অচেনা
তাই ছুঁয়ে দেখা
এ অবগাহন শরীর-বাহন চির ভালোবাসা!


জয়ী নই, পরাজিত নই
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল
আমি এই পৃথিবীকে পদতলে রেখেছি
এই আক্ষরিক সত্যের কছে যুক্তি মূর্ছা যায়।
শিহরিত নির্জনতার মধ্যে বুক টন্‌‌টন করে ওঠে
হাল্‌কা মেঘের উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন
সবুজকে ধূসর হতে ডাকে
আ-দিগন্ত প্রান্তের ও টুকরো ছড়ানো টিরার উপর দিয়ে
ভেসে যায় অনৈতিহাসিক হাওয়া
অরণ্য আনে না কোনো কস্তুরীর ঘ্রাণ
কিছু নিচে ছুটন্ত মহিলার গোলাপি রুমাল উড়ে গিয়ে পড়ে
ফণমনসার ঝোপে
নিঃশব্দ পায়ে চলে যায় খরগোশ আর রোদ্দুর।
এই যে মুহূর্তে, এই যে দাঁড়িয়ে থাকা–এরই কোনো অর্থ নেই
ঝর্নার জলে ভেসে যায় সম্রাটের শিরস্ত্রাণ
কমলার কোয়া থেকে খসে পড়া বীজ ঢকে পড়ে পাতাল গর্ভে
পোল্‌কা ডট্‌ দুটি প্রজাপতি তাদের আপন আপন কাজে ব্যস্ত
বাব্‌‌লা গাছের শুক্‌নো কাঁটাও দাবী করেছে প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব।
সব দৃশ্যই এমন নিরপেক্ষ
আমি জয়ী নই, আমি পরাজিত নই, আমি এমনই একজন মানুষ
পাহাড় চূড়ায় পৃথিবীকে পদতলে রেখে, আমার নাভিমূল
থেকে উঠে আসে বিষণ্ন, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস
এই নির্জনতাই আমার ক্ষমাপ্রার্থী অশ্রুমোচনের মুহূর্ত।।


আমার কৈশোর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শিউলি ফুলের রাশি শিশিরের আঘাতও সয় না
অন্তর আমার কৈশোরে তারা এ-রকমই ছিল
এখন শিউলি ফুলের খবরও রাখি না অবশ্য
জানি না, তারা স্বভাব বদলেছে কিনা।
আমার কৈশোরে শিউলির বোঁটার রং ছিল শুধু
শিউলির বোঁটারই মতন
কোনো কিছুর সঙ্গেই তার তুলনা চলতো না
আমার কৈশোরে পথের ওপর ঝরে পড়ে থাকা
শিশির মাখা শিউলির ওপর পা ফেললে
পাপ হতে
আমার পাপ কাটাবার জন্য প্রণাম করতাম।
আমার কৈশোরে শিউলির সম্মানে সরে যেত বৃষ্টিময় মেঘ
তখন রেদ্দুর ছিল তাপহীন উজ্জ্বল
দু’হাত ভরা শিউলির ঘ্রাণ নিতে নিতে মনে হতো
আমার কোনো গোপন দু:খ নেই, আমার হৃদয়ে
কোনো দাগ নেই
পৃথিবীর সব আকাশ থেকে বেজে উঠেছে উৎসবের বজনা।
শাদা শিউলির রাশি বড় স্তব্ধ, প্রয়োজনহীন, দেখলেই
বলতে ইচ্ছে করতো,
আমি কারুকে কখনো দু:খ দেবো না-
অন্তত এ-রকমই ছিলো আমার কৈশোরে
এখন অবশ্য শিউলি ফুলের খবরও রাখি না।।


জনমদুখিনী
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যতদিন ছিলে তুমি পরাধীনা ততদিন ছিলে তুমি সবার জননী
এখন তোমাকে আর মা বলে ডাকেনা কেউ
লেখেনা তোমার নামে কবিতা
বুক মোচড়ানো সুরে সেইসব গান
গুপ্ত কুঠুরিতে মৃদু মোমের আলোর সামনে আবেগের মাতামাতি
জনমদুখিনী মা কোনদিন স্বাধীনা হলেনা
এখন তোমাকে আর ভুলেও ডাকেনা কেউ
আঁকেনা তোমার কোন ছবি
কেউ কারো ভাই নয়, রক্তের আত্মীয় নয়
নদীর এপার দিয়ে, নদীর অপার দিয়ে চলে যায় বিষন্ন মানুষ
Photo: জনমদুখিনী /(সুনীল) যতদিন ছিলে তুমি পরাধীনা ততদিন ছিলে তুমি সবার জননী এখন তোমাকে আর মা বলে ডাকেনা কেউ লেখেনা তোমার নামে কবিতা বুক মোচড়ানো সুরে সেইসব গান গুপ্ত কুঠুরিতে মৃদু মোমের আলোর সামনে আবেগের মাতামাতি জনমদুখিনী মা কোনদিন স্বাধীনা হলেনা এখন তোমাকে আর ভুলেও ডাকেনা কেউ আঁকেনা তোমার কোন ছবি কেউ কারো ভাই নয়, রক্তের আত্মীয় নয় নদীর এপার দিয়ে, নদীর অপার দিয়ে চলে যায় বিষন্ন মানুষ


আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কি মানুষজন্ম ? নাকি শেষ
পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা ! প্রতি সন্ধেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি – তার ভেতরের কুকুরটা দেখব বলে। আমি আক্রশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে –
(ও গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই !)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়েয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি । নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশী ছিল কি না ।
আমি ফুলের পাশে ফুল হয়ে ফুটে দেখেছি, তাকে ভালবাসতে পারি না ।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।

নিখিলেশ, আমি এই রকম ভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না আমার – এ কি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো দুব সাঁতার ? – অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন ? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা ? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয় । মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে আছে । ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বাণ্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি । আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি …, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিলো না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে । তবু, ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ রকম জলচেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাতড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর । ইঁদুর নয় মূষিক ? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক ? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই
অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না । আমার পূজা ও নারী হত্যার ভিতরে
বেজে উঠে সাইরেন । নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো
কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের । আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় এক পলক সত্যি চোখ । এ রকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশি নেই আর ।


গণদাবি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কথা ও সুর: কবীর সুমন

বিমানে উড়তে তিরিশ মিনিট
এতো কাছে তবু দূর
বিলকুল নেই পাসপোর্ট ভিসা
সীমানা চেনেনা সুর।

সীমানা চিনিনা আছি শাহবাগে
আমার গীটারও আছে,
বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখো
গণদাবী হয়ে বাঁচে।

বাঁচো গণদাবী, বাঁচো গণদাবী
আসল বিচার চাই,
যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও
গণদাবী একটাই।


প্রজন্ম চত্তর থেকে উনিশশো একাত্তর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মা, তোমার কিশোরী কন্যাটি আজ নিরুদ্দেশ
মা, আমারও পিঠোপিঠি ছোট ভাইটি নেই
নভেম্বরে দারুণ দুর্দিনে তাকে শেষ দেখি
ঘোর অন্ধকারে একা ছুটে গেল রাইফেল উদ্যত।
এখন জয়ের দিন, এখন বন্যার মত জয়ের উল্লাস
জননীর চোখ শুকনো, হারান কন্যার জন্য বৃষ্টি নামে
হাতখানি সামনে রাখা, যেন হাত দর্পন হয়েছে
আমারো সময় নেই, মাঠে কনিষ্ঠের লাশ খুঁজে ফিরি।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
একা একা হাহাকার; আজিজুর, আজিজুর, শোন—
আমার হলুদ শার্ট তোকে দেবো কথা দেওয়া ছিল
বেহেস্তে যাবার আগে নিলিনা আমার দেহঘ্রাণ?
লিকলিকে লম্বা ছেলে যেন একটা চাবুক, চোয়ালে
কৈশোরের কাটা দাগ, মা’র চোখে আজও পোলাপান
চিরকাল জেদী ! বাজির গহবর ফেলে নদী থেকে মাটি তুলে আনতো
মশার জ্বালিয়ে আমি ভাগাড়ের হাড়মুন্ডে চিনবো কি তাকে?
মা, তোমার লাবণ্যকে শেষ দেখি জুলায়ের তেসরা
শয়তানের তাড়া খেয়ে ঝাঁপ দিল ভরাবর্ষা নদীর পানিতে
জাল ফেলে তবু ওকে টেনে তুললো, ছটফটাচ্ছে যেন
এক জলকন্যা
স্টিমারঘাটায় আমি তখন খুঁটির সঙ্গে পিছমোড়া বাধা ।
ক’টা জন্তু নিয়ে গেল টেনে হিচড়ে, হঠাত লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে
তাকালো সবার চোখে, দৃষ্টি নয়, দারুণ অশনি
ঐটুকু মেয়ে, তবু এক মুহুর্তেই তার রূপান্তর ত্রিকাল-মায়ায়
কুমারীর পবিত্রতা নদীকেও অভিশাপ দিয়ে গেল ।
মা তোমার লাবণ্যকে খুঁজেছি প্রান্তরময়, বাঙ্কারে ফক্সহোলে
ছেঁড়া ব্রা, রক্তাক্ত শাড়ী – লুন্ঠিত সীতার মতো চিহ্ন পড়ে আছে
দূরে কাছে কয়েক লক্ষ আজিজুর অন্ধকার ফুঁড়ে আছে
ধপধপ হাড়ে
কোথাও একটি হাত মাটি খিমচে ধরতে চেয়েছিল।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
বাঁ হাতের উল্টোপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়
কবরে লুকিয়ে ঢোকে ফুলচোর, মধ্য রাত্রে ভেঙে যায় ঘুম
শিশুরা খেলার মধ্যে হাততালি দিয়ে ওঠে, পাখিরাও
এবার ফিরেছে।


দেখা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভালো আছো?
– দেখো মেঘ বৃষ্টি আসবে।
ভালো আছো?

– দেখো ঈশান কোনের আলো, শুনতে পাচ্ছো ঝড়?
ভালো আছো?
-এইমাত্র চমকে উঠলো ধপধপে বিদ্যুৎ ।
ভালো আছো?
– তুমি প্রকৃতিকে দেখো।
– তুমি প্রকৃতি আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছো।
আমিতো অণুর অণু, সামান্যর চেয়েও সামান্য।
তুমি জ্বালাও অগ্নি, তোল ঝড়, রক্তে এতো উন্মাদনা।
– দেখো সত্যিকার বৃষ্টি, দেখো সত্যিকার ঝড়।
তোমাকে দেখাই আজোশেষ হয়নি,
তুমি ভালো আছো


শুধু কবিতার জন্য
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।


তোমার কাছেই
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সকাল নয়, তবু আমার
প্রথম দেখার ছটফটানি
দুপুর নয়, তবু আমার
দুপুরবেলার প্রিয় তামাশা
ছিল না নদী, তবুও নদী
পেরিয়ে আসি তোমার কাছে
তুমি ছিলে না তবুও যেন
তোমার কাছেই বেড়াতে আসা!
শিরীষ গাছে রোদ লেগেছে
শিরীষ কোথায়, মরুভূমি!
বিকেল নয়, তবু আমার
বিকেলবেলর ক্ষুৎপিপাসা
চিঠির খামে গন্ধ বকুল
তৃষ্ণা ছোটে বিদেশ পানে
তুমি ছিলে না তবুও যেন
তোমার কাছেই বেড়াতে আসা!


জন্ম হয়না, মৃত্যু হয়না
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার ভালোবাসার কোন জন্ম হয়না
মৃত্যু হয়না–
কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হীরের গয়না
শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।
আমার কেউ নাম রাখেনি, তিনটে চারটে ছদ্মনামে
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে,
আগুন দেখে আলো ভেবেছি, আলোয় আমার
হাত পুড়ে যায়
অন্ধকারে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘুর্ণিমায়ায়
অন্ধকারে মিশে থেকেছি
কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’ চোখে হাজার ছি ছি
তবুও আমার জন্ম-কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি
আমার কোন ভয় হয়না,
আমার ভালোবাসার কোন জন্ম হয়না, মৃত্যু হয়না।


মন ভাল নেই
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমন কি সুরা এমন কি ভাষা
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কি আছে অথবা কি ছিল
আমার কি আছে অথবা কি ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
আশায় আশায়…


ব্যর্থ প্রেম
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই

সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের সাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন

আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে

আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে

আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।


যদি নির্বাসন দাও
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূম
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘুরে
লুঠেরা, ফেরারী ।
শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর,
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্পোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল–
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পারে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক ?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলার ওড়াওড়ি ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো… ।


চে গুয়েভারার প্রতি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!


কেউ কথা রাখেনি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!


ইচ্ছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কাচের চুড়ি ভাঙ্গার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয়,
দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি
পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট
যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি
কাচের চুড়ি ভাঙ্গার মতোই ইচ্ছে করে অবহেলায়
ধর্মতলায় দিন দুপুরে পথের মধ্যে হিসি করি।
ইচ্ছে করে দুপুরে রোদে ব্ল্যাক আউটে হুকুম দেবার
ইচ্ছে করে বিবৃতি দেই ভাওতা মেরে জনসেবার
ইচ্ছে করে ভাওতাবাজ নেতার মুখে চুনকালি দেই।
ইচ্ছে করে অফিস যাবার নাম করে যাই বেলুড় মঠে
ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মুর্গীহাটায়
বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাচের চুড়ি দেখলে ভাঙ্গি
ইচ্ছে করে লন্ডভন্ড করি এবার পৃথিবীটাকে
মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি
আমার কিছু ভাল্লাগেনা ।


কৃত্তিবাস
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ছিলে কৈশোর যৌবনের সঙ্গী, কত সকাল,
কত মধ্যরাত,
সমস্ত হল্লার মধ্যে ছিল সুতো বাঁধা,
সংবাদপত্রের খুচরো গদ্য
আর প্রইভেট টিউশানির টাকার অর্ঘ্য
দিয়েছি তোমাকে, দিয়েছি ঘাম,
ঘোরঘুরি, ব্লক, বিজ্ঞাপন, নবীন কবির
কম্পিত বুক, ছেঁড়া পাঞ্জাবি
ও পাজামা পরে কলেজপালানো দুপুর,
মনে আছে মোহনবাগান
লেনের টিনের চালের ছাপাখানায়
প্রুফ নিয়ে বসে থাকা ঘন্টার পর
ঘন্টা, প্রেসের মালিক কলতেন,
খোকা ভাই, অত চার্মিনার খেও না,
গা দিয়ে মড়া পোড়ার গন্ধ বেরোয়, তখন
আমরা প্রায়ই যেতাম
শ্মশানে, শরতের কৌতুক ও শক্তির
দুর্দান্তপনা, সন্দীপনের চোখ মচকানো,
এর কী দুরন্ত নাচ
সমরেন্দ্র, তারাপদ আর উৎপলের
লুকোচুরি, খোলা হাস্য
জমে উঠেছিল এক নদীর কিনারে,
ছিটকে উঠেছিল জল, আকাশ
ছেয়েছিল লাল রঙের ধুলোয়, টলমল
করে উঠেছিল দশ দিগন্ত, তারপর
আমরা ব্যক্তিগত জাতীয় সঙ্গীত
গাইতে-গাইতে বাতাস সাঁতরে চলে
গেলাম নিরুদ্দেশে


কেউ শুধালোনা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মাথায় একটা ডান্ডা, একটা বুনো শব্দ, শেষ !
লোকটা মরে পড়ে রইলো,
লোকটা মরে পড়ে রইলো শিশির ভেজা মাঠে !

লোকটা কোনো শিশুর গালে
দেয়নি বুঝি টোকা ?
ঘোমটা পরা নারীর হাত মুঠোয় ধরে
পার হয়নি মাঠের রেললাইন ?
এই লোকটি মাটিকে ভালোবাসেনি ?
এই লোকটি ধানের গন্ধ নেয়নি ?
এই লোকটি শীতের রাতে নিজের গায়ের কাঁথা
দেয়নি অন্যকে ?
এসব কেউ শুধালোনা
যাবার পথে একবারও কেউ ফিরে তাকালোনা
লোকটা মরে পড়ে রইলো,
লোকটা মরে পড়ে রইলো শিশির ভেজা মাঠে !


চায়ের দোকানে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,
রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস
দীপু তো শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল
এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ
তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক;
আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল
সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!
কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ
সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে –
এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ
দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ?
গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম
এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই
আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।


নীরার হাসি ও অশ্রু
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীরার চোখের জল অনেক চোখের অনেক
নীচে
টল্‌মল্‌
নীরার মুখের হাসি মুখের আড়াল থেকে
বুক, বাহু, আঙুলে
ছড়ায়
শাড়ির আঁচলে হাসি, ভিজে চুলে, হেলানো সন্ধ্যায় নীরা
আমাকে বাড়িয়ে দেয়, হাস্যময় হাত
আমার হাতের মধ্যে চৌরাস্তায় খেলা করে নীরার কৌতুক
তার ছদ্মবেশ থেকে ভেসে আসে সামুদ্রিক ঘ্রাণ
সে আমার দিকে চায়, নীরার গোধূলি মাখা ঠোঁট থেকে
ঝরে পড়ে লীলা লোধ্র
আমি তাকে প্রচ্ছন্ন আদর করি, গুপ্ত চোখে বলি :
নীরা, তুমি শান্ত হও
অমন মোহিনী হাস্যে আমার বিভ্রম হয় না, আমি সব জানি
পৃথিবী তোলপাড় করা প্লাবনের শব্দ শুনে টের পাই
তোমার মুখের পাশে উষ্ণ হাওয়া
নীরা, তুমি শান্ত হও!
নীরার সহাস্য বুকে আঁচলের পাখিগুলি
খেলা করে
কোমর ও শ্রোণী থেকে স্রোত উঠে ঘুরে যায় এক পলক
সংসারের সারাৎসার ঝলমলিয়ে সে তার দাঁতের আলো
সায়াহ্নের দিকে তুলে ধরে
নাগকেশরের মতো ওষ্ঠাধরে আঙুল ঠেকিয়ে বলে,
চুপ!
আমি জানি
নীরার চোখের জল চোখের অনেক নিচে টল্‌মল্‌।।


অনর্থক নয়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বেয়ারা পাঠিয়ে কারা টাকা তোলে ব্যঙ্ক থেকে?
আমি তো নিজের সইটা এখনো চিনি না
বিষম টাকার অভাব!নেই। শুধু হৃৎপিন্ড হাওয়া টেনে নেয়ে
হাসি কুলকুচো করি। মাথায় মুকুট নেই বলে
কেউ ধার দিতেও চায় না।
কিছু টাকা জমা আছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। সামান্য।
কাঁটা ছাড়ানো মাছের মতন
গদ্য লিখলে ক্যাশ আসে। পারি না। কবিতায় দশ টাকা
তাই বা মন্দ কি, কত দীর্ঘ দিন বন্ধুদের টেবিলে বসিনি।
কতই তো দিলে বিধি- চোখ, নাক, হাত, ডিগ্রি, জিভ, ঘোরাঘুরি
কয়েকখানা বড় সাইজ উপন্যাস শেষ করার সামর্থ দিলে না?
শিল্পের জননী নাকি দুঃখ? সর্বনাশ, আমার তো কোনো দুঃখ নেই।
খুব গোপনে জানাচ্ছি
(একমাত্র টাকা কিংবা দুঃখ না-থাকার-দুঃখ যদি গণ্য হয়!)
কে কোথায় পায়নি প্রেম, এর সঙ্গী ভোগ করছে ওর সন্ধেবেলা
এসব চমৎকার লাগে।
কে যেন আমায় কথা দিয়েছিল! কথা সাঁতরে গেছে অন্ধকারে-
ভয়ঙ্কর জানলা খুলে রাত দুটোয় এক ঝলক আলো এসে পড়ে
মাঝে মাঝে চোখে মুখে। অমনি চেঁচিয়ে উঠি উল্লাসে মুখ তুলেঃ
বিশ্বাসঘাতিনী ভাগ্যে হয়েছিলে নারী, তাই বেঁচে থাকা এত রোমাঞ্চের
নেশাফেশা কিছু নেই, দুঃখ নেই, গোপনে চুপচাপ বাঁচতে চাই
তাও কত শক্ত দেখেছি, চারবেলা অদ্ভুত চাকরি, ঘুমহীন চোখে
কবিতার আরাধনা
কেন এই আরাধনা? ওভারটাইম দশা টাকা?
ছোট ছোট ঝাল লঙ্কা কিংবা ঠিক টিনের চিরুনির মতো রেদে
পঞ্চাশটা কাবুলিকে স্বপ্ন দেখে আজ দুপুরে চমকে গেছি ট্রামে।
কোর্বন স্ট্রীটের মোড়ে বুড়ো দরবেশ চাইলো অমরত্ব খুবই আন্তরিক
কপালে কুষ্ঠের কাদা। তিনটে নয়া পয়সা দিয়ে মানুষের মতো অভিমান
সংকেতবিহীন কন্ঠে জানালুমঃ
যদি রাস্তা চিনতে পারো, যাও হে অনন্তধামে সন্ধের আগেই
ঈশ্বরের পাশে একটি তোমার জন্যেই খালি আসন রয়েছে আমি জানি
পরমহূর্তেই আমি পামের পাগলীর কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে-
তিনটে পয়সা দাও ভাই আজ আমাকে
গাড়ি ভাড়া নেই বহুদূরে যেতে হবে।
মায়ের তোরঙ্গ থেকে সিঁদুরের গুড়ো ঝেড়ে আজও
সম্রাট পঞ্চম জর্জ কাটামুন্ডে সহাস্য বয়াস
যাও মাছের বাজারে ইয়োর ম্যাজিস্টি , পুঁইশাক, সিগারেট, কুমড়োয়
দেখি কতো তোমার মুরোদ! সব ম্যাজিক ভুলে গেছি-
একত্রিশ হারিখে দেখছি অ্যালয়ের কুশব্দ ইয়ার্কি
এখানে ওখানে নদী- কালো জল, প্রত্যহ স্নান সেরে বহু পবিত্র গন্ডার
চৌরঙ্গীর চতুর্দিকে হুটোপুটি করে- হাসে, মেয়েদের খোলা তলপেটে
সুড়সুড়ি দেয় কিংবা ঠোঁট চাটে, নুন ঝাল মিশিয়ে
প্রথম শীতের এই মনোরম সন্ধ্যাগুলি কাঁটা চামচে দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
সুস্বাদে চিবিয়ে খায়। সমস্ত রাস্তাই আজ ভিড়ে ভর্তি ভিড়ে
ভর্তি, অসম্ভব, আমি হঠাৎ কোথায় আজ হারালুম আমার নিজস্ব
গোপন প্রস্থান পথ- এ দুর্দিনে ফটকার বাজারে!


নীরার পাশে তিনটি ছায়া
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীরা এবং নীরার পাশে তিনটি ছায়া
আমি ধনুকে তীর জুড়েছি, ছায়া তবুও এত বেহায়া
পাশ ছাড়ে না
এবার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো–
নীরা দু’হাত তুলে বললো, ‘মা নিষাদ!
ওরা আমার বিষম চেনা!’
ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে ওড়ে আমার বুক চাপা বিষাদ–
লঘু প্রকোপে হাসলো নীরা, সঙ্গে ছায়া-অভিমানীরা
ফেরানো তীর দৃষ্টি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল
নীরা জানে না!


কিছু পাগলামি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

জুলপি দুটো দেখতে দেখতে শাদা হয়ে গেল!
আমাকে তরুণ কবি বলে কেউ ভুলেও ভববে না
পরবর্তী অগণন তরুণেরা এসেছে সুন্দর ক্রুদ্ধ মুখে
তাদের পৃথিবী তারা নিজস্ব নিয়মে নিয় নিক!
আমি আর কফি হাউস থেকে হেঁটে হেঁটে হেঁটে
নিরুদ্দিষ্ট কখনো হবে না
আমি আর ধোঁয়া দিয়ে করবো না ক্ষিদের আচমন্‌‌!
আমি আর পকেটে কবিতা নিয়ে ভেরবেলা
বন্ধবান্ধবের বাড় যাবো না কখনো
হসন্তকে এক মাত্রা ধরা হবে কিনা এর তর্কে আর
ফাটাবো না চায়ের টেবিল
আর কি কখনো আমি সুনীলকে মিল দেব
কণ্ডেন্সড্‌ মিল্কে?
এখন ক্রমশ আমি চলে যাবো তুমি’-র জগৎ ছেড়ে
আপনি’-র জগতে
কিছু প্রতিরোধ করে, হার মেনে, লিখে দেব
দুটি প্রতিরোধ করে, হার মেনে, লিখে দেব
দুটি একটি বইয়ের ভূমিকা
আকস্মাৎ উৎসব-বাড়িতে পূর্ব প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হলে
তার হৃষ্টপুষ্ট স্বামীটির সঙ্গে হবে
রাজনীতি নিয়ে আলোচনা
দিন যাবে, এরকমভাবে দিন যাবে!
অথচ একলা দিনে, কেউ নেই, শুয়ে আমি আমি আর
বুকের ওপরে প্রিয় বই
ঠিক যেন কৈশোরে পেরিয়ে আসা রক্তমাখা মরূদ্যান
খেলা করে মাথার ভিতরে
জঙ্গলের সিংহ এক ভাঙা প্রাসাদের কোণে
ল্যাজ আছড়িয়ে তোলে গম্ভীর গর্জন
নদীর প্রাঙ্গণে ওই স্নিগ্ধ ছায়ামূর্তিখানি কার?
ধড়ফড় করে উঠে বসি
কবিতার খাতা খুলে চুপে চাপে লিখে রাখি
গতকালপরশুর কিছু পাগলামি!


নারী
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নাস্তিকেরা তোমায় মানে না, নারী
দীর্ঘ-ঈ-কারের মতো তুমি চুল মেলে
বিপ্লবের শত্রু হয়ে আছো !
এমন কি অদৃশ্য তুমি বহু চোখে
কত লোক নামই শোনেনি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং-আলো…
তারা চেনে প্রেমিকা বা সহোদরা
জননী বা জায়া
দুধের দোকানে মেয়ে, কিংবা যারা
নাচে গায়
রান্না ঘরে ঘামে
শিশু কোলে চৌরাস্তায় বাড়ায় কঙ্কাল হাত
ফ্রক কিংবা শাড়ি পরে দুঃখে ইস্কুলে যায়
মিস্তিরির পাশে থেকে সিমেন্টে মেশায় কান্না
কৌটো হাতে পরমার্থ চাঁদা তোলে
কৃষকের পান্তাভাত পৌঁছে দেয় সূর্য ক্রুদ্ধ হলে
শিয়রের কাছে রেখে উপন্যাস
দুপুরে ঘুমোয়
এরা সব ঠিকঠাক আছে
এদের সবাই চেনে শয়নে, শরীরে
দুঃখ বা সুখের দিনে
অচির সঙ্গিনী !
কিন্তু নারী ? সে কোথায় ?
চল্লিশ বছর ধরে অবক্ষয়ী কবি-দল
যাকে নিয়ে এমন মেতেছে ?
সে কোথায় ? সে কোথায় ?
দীর্ঘ-ঈ-কারের মতো চুল মেলে
সে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ?
এই ভিড়ে কেমন গোপন থাকো তুমি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং আলো…


যা চেয়েছি যা পাবো না
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যা চেয়েছি, যা পাবো না
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো
দূরবর্তী নৌকো
চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-মনে হয় তুমি দেবী…
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে
তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে-
কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন
শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন
কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে
তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি
ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ?
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ…
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু’হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে–
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু’চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?


বাড়ি ফেরা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাত্তির সাড়ে বারোটায় বৃষ্টি, দুপুরে অত্যন্ত শুক্‌নো এবং ঝক্‌ঝকে
ছিল পথ, মেঘ থেকে কাদা ঝরেছে, খুবই দুঃখিত মূর্তি একা
হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, কালো ভিজে চুপচাপ দ্বিধায়
ট্রাম বাস বন্ধ, রিক্সা ট্যাক্সি-পকেটে নেই, পৃথিবী তল্লাসী হয়ে গেছে পরশুদিন
পুলিশের হাতে শাস্তি এখন, অথবা নির্জনতাই প্রধান অস্ত্র এই বুধবার রাত্তিরে।
অনেক মোটরকারের শব্দ হয় না, ঘুমন্ত হেডলাইট, শুধু পাপপূণ্য
অত্যন্ত সশব্দে জেগে আছে, কতই তো প্রতিষ্ঠান উঠে যায়, ওরা শুধু
ঘাড়হীন অমর-গোঁয়ার।

মশারী ব্যবসায়ীদের মুন্ডুপাত হচ্ছে নর্দমায়, কলকন্ঠে, ঘুমহীন ঘুম
শিকে নিয়েছে ট্রাক ড্রাইভার। দু’পাশের আলো-জ্বলা অথবা
অন্ধকার ঘরগুলোয়
জন্মনিয়ন্ত্রণ জনপ্রিয় হয়নি। অসার্থক যৌন ত্রিয়ার পর
বারান্দায় বিড়ি খাচ্ছে বুড়ো লোটা, ঘন ঘন আগুনের চিহ্ন দেখে
বোঝা যায় কী তীব্র ওর দুঃখ! মৃত্যুর খুব কাছাকাছি-
হয়তো লোকটা
গত দশ বছর ধরে মরে গেছে, আমি বেঁচে আছি আঠাশ বছর।

সাত মাইল পদশব্দ শুনে কেউ পাগলামীর সীমা ছুঁয়ে যায় না
এ রাস্তা অনন্তে যায়নি, ডাদিকে বেঁকে কামিনী পুকুরে
দুই ব্রীজের নিচে জল, পাৎলুন গোটানো হলো, এই ঠান্ডা স্পর্শ
একাকী মানুষকে বড় অনুতাপ এনে দেয়-
লইট পোস্টে ওঠে বাল্‌ব চুরি করছে একজন, এই চোট্ট, তোর পকেটে
দেশলই আছে?
বহুক্ষণ সিগারেট খাইনি তাই একা লাগছে, দেশলাইটা নিয়ে নিলাম
ফেরত পাবি না
বল্‌ব চুরি করেই বাপু খুশি থাক না, দু’রকম আলো বা আগুন
এক জীবনে হয় না!….ভাগ শালা…..

ও-পাশে নীরেনবাবুর বাড়ি, থাক্‌্‌। এ-সময় যাওয়া চলে না- ডাকাতের
ছদ্মবেশ ছাড়া
চায়ের ফরমাস করলে নিশ্চয়ই চা খওয়াতেন, তিনদিন পরে
অন্য প্রসঙ্গে ভর্ৎসনা
একটু দূরে রিটায়ার্ড জজসাহেবের সুরম্য হর্ম্যের
দেয়াল চক্‌্‌ চকে শাদা, কী আশ্চর্য, আজো শাদা! টুকরো কাটকয়লায়
লিখে যাবো নাকি, আমি এসেছিলাম, যমদূত, ঘমন্ত দেখে ফিরে গেলম
কাল ফের আসবো, ইতিমধ্যে মায়াপাশ ছিন্ন করে রাখবেন নিশ্চই!

কুত্তারা পথ ছাড়! আমি চোর বা জোচ্ছোর নই, অথবা ভূত প্রেত
সমান্য মানুষ একা ফিরে যাচ্ছি নিজের বড়িতে
পথ ভুল হয়নি, ঠান্ডা চাবিটা পকেটে, বন্ধ দরজার সামনে থেমে
তিনবার নিজের নাম ধরে হাকবো, এবং তৎক্ষাণাৎ সুইচ টিপে
এলোমেলো অন্ধকার সরিয়ে
আয়নায় নিজের মুখ চিনে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে ঢুকবো ঘরে।।


পতন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

স্মৃতি এসে বলে ঃ পূর্ব দিকে যাও, তোমার নিয়তি
প্রতীক্ষায় আছে-
আমি তাকে চোখ তুলে দেখাই ও প্রাসাদের বিশাল পতন-
ভাঙে হৃদয় গম্বুজ, ইটকাঠ, ভয়ঙ্কর শব্দে পড়ে
কড়ি বরগা
পিতার টেম্পারা ছবি, জংধরা সিন্দুক
ওড়ে সিন্দুর মাখানো রাজমুদ্রা, শূন্য খাঁচা, অবিরল
মেঘের গর্জন
মায়ের দুঃখিত মুখ, নবীনা নারীর চোখ ভেসে যায়
ভেসে যায় স্তনযোগে প্রথম উষ্ণতা,
ওকি অসম্ভব শব্দ, প্রবল হাওয়ায় ভাসে ছিন্ন হাত, বই
লুকানো বাজির মতো মধ্যরাতে জেগে ওঠে রক্তমাখা বাল্যের প্রেমিকা
ফেটে পড়ে সহস্র শব্দের ভান্ড, আমি পাশ ফিরে
দেখি, ততক্ষণে
গুপ্তচর স্মৃতি পেয়ে গেছে অ্যাকিলিসের গোড়ালি ।


দ্বারভাঙা জেলার রমণী
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

হাওড়া ব্রীজের রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল
দ্বারভাঙা জেলা থেকে আসা টাট্‌কা রমনী
ব্রীজের অনেক নিচে জল, সেখানে কোনো ছায়া পড়ে না
কিন্তু বিশাল এক ভগবতী কুয়াশা কলকাতার উপদ্রুত অঞ্চল থেকে
গড়িয়ে এসে
সভ্যতার ভূমধ্য অরিন্দে এসে দাঁড়ালো
সমস্ত আকাশ থেকে খসে পড়লো ইতিহাসের পাপমোচানবারী বিষণ্ণতা
ক্রমে সব দৃশ্য, পথ ও মানুষ মুছে যায়, কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু রইলো সেই
লাল ফুল-ছাপ শাড়ি জড়ানো মূর্তি
রেখা ও আয়তনের শুভবিবাহমূলক একটি উদাসীন ছবি-
আকস্মাৎ ঘুরে গাঁড়ালো সে, সেই প্রধানা মচকা মাগি, গোঠের মল ঝামড়ে
মোষ তাড়ানোর ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো, ইঃ রে-রে-রে-রে-
মুঠো পিছলোনো স্তনের সূর্যমুখী লঙ্কার মতো বোঁটায় ধাক্কা মারলো কুয়াশা
পাছার বিপুল দেলানিতে কেঁপে উঠলো নাদব্রহ্ম
অ্যাক্রোপলিসের থামের মতো উরুতের মাঝখানে
ভাটফুলে গন্ধ মাখা যোনির কাছে থেমে রইলো কাতর হওয়া
ডৌল হাত তুলে সে আবার চেঁচিয়ে উঠলো, ইঃ রে-রে-রে-রে-
তখন সর্বনাশের কাছে সৃষ্টি হাঁটু গেড়ে বসে আছে
তখন বিষণ্নতার কাছে অবিশ্বাস তার আত্মার মুক্তিমূল্য পেয়ে গেছে…
সব ধ্বংসের পর
শুধু দ্বারভাঙা জেলার সেই রমণীই সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো
কেননা ‌ঐ মুহূর্তে সে মোষ তাড়ানোর স্বপ্নে দেখছিল।।


নীরার দুঃখকে ছোঁয়া
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কতটুকু দূরত্ব? সহস্র আলোকবর্ষ চকিতে পার হয়ে
আমি তোমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসি
তোমার নগ্ন কোমরের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলার আগে
অলঙ্কৃত পাড় দিতে ঢাকা অদৃশ্য পায়ের পাতা দুটি
বুকের কাছে এনে
চুম্বন ও অশ্রুজলে ভেজাতে চাই
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বুক কাঁপে
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বাইরের জীবন মিথ্যে হয়ে যায়
বহুকাল পর অশ্রু বিস্মৃত শব্দটি
অসম্ভব মায়াময় মনে হয়
ইচ্ছে করে তোমার দুঃখের সঙ্গে
আমার দুঃখ মিশিয়ে আদর করি
সামাজিক কাঁথা সেলাই করা ব্যবহার তছনছ করে
স্ফুরিত হয় একটি মুহূর্ত
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে তোমার পায়ের কাছে…

বাইরে বড় চ্যাঁচামেচি, আবহাওয়া যখন তখন নিম্নচাপ
ধ্বংস ও সৃষ্টির বীজ ও ফসলে ধারাবাহিক কৌতুক
অজস্র মানুষের মাথা নিজস্ব নিয়মে ঘামে
সেই তো শ্রেষ্ঠ সময় যখন এ-সবকিছুই তুচ্ছ
যখন মানুষ ফিরে আসে তার ব্যক্তিগত স্বর্গের
অতৃপ্ত সিঁড়িতে
যখন শরীরের মধ্যে বন্দী ভ্রমরের মনে পড়ে যায়
এলাচ গন্ধের মতো বাল্যস্মৃতি
তোমার অলোকসামান্য মুখের দিকে আমার স্থির দৃষ্টি
তোমার রেজী অভিমানের কাছে প্রতিহত হয়
দ্যুলোক-সীমানা
প্রতীক্ষা করি ত্রিকাল দুলিয়ে দেওয়া গ্রীবাভঙ্গির
আমার বুক কাঁপে,
কথা বলি না
বুকে বুক রেখে যদি স্পর্শ করা যায় ব্যথাসরিৎসাগর
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি অসম্ভব দূরত্ব পেরিয়ে
চোখ শুকনো, তবু পদচুম্বনের আগে
অশ্রুপাতের জন্য মন কেমন করে!


নারী ও শিল্প
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি
উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু
ঠোঁটে স্বপ্ন বিংবা অসমাপ্ত কথা
এ যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, বিংবা
দর্পণের ঘরে বস
চিবুকের ওপরে এসে পড়েছে চুলের কালো ফিতে
সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না, কেননা আবহমান কাল
থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা কয়েছে
আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,
এ রকম হয়
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো
এই নারী
নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে
নিছক ভদ্রতাবশে নিভিয়ে দিই আলো
তারপর শুরু হয় শিল্পকে ভাঙার এক বিপুল উৎসব
আমি তার ওষ্ঠ ও উরুতে মুখ গুঁজে
জানাই সেই খবর
কালস্রোত সাঁতরে যা কোথাও যায় না।


নীরার জন্য কবিতার ভুমিকা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা
এ কবিতার মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে
ঘুমের ভিতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে টিপয়ের
থেকে জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে এক মুহুর্ত ভাববে
কে তোমায় মনে করছে এত রাত্রে — তখন আমার
এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কমা ড্যাশ রেফ
ও রয়ের ফুটকি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার
আধো ঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও
বিছানায় আমার নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলো
এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু
তোমার জন্য, এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে
তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহু দূরে আছি
আমার ভযংকর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না — আমার সম্পূর্ণ আবেগ
শুধু মোমবাতির আলোর মতো ভদ্র হিম,
. শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে — এরা তোমাকে চুম্বন করলে
তুমি টের পাবে না, এরা তোমার সঙ্গে সারা রাত শুয়ে থাকবে
এক বিছানায় — তুমি জেগে উঠবে না, সকালবেলা তোমার পায়ের
কাছে মরা প্রজাপতির মতো লুটোবে | এদের আত্মা মিশে
থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো
বহুদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্নার জলের মতো
হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে | নীরা, আমি তোমার অমন
সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো | আমি অন্য কথা
বালার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে-মনে
ঘর ভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে
. নিজস্ব চোখে তাকাবো |
তুমি জানতে পারবে না — তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে |
আমার একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা |


হঠাৎ নীরার জন্য
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে
বহুক্ষণ দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–
দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে,
নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।

দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে,
কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর,ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে গেছে নীল জলে
তোমাকে হঠাত্‍ মনে হলো কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।

এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন
মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের
মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর
ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে বাহান্ন তীর্থের মতো
তোমার ও-শরীর ভ্রমণে পুণ্যবান হবো।
বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
বাড়িতে আসবেন!’

রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে-পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন
ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্টের দরজায়।

বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল দেখেছি স্বপ্নে বহুক্ষণ।


ভালোবাসার পাশেই
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে
ওকে আমি কেমন করে যেতে বলি
ও কি কোনো ভদ্রতা মানবে না?
মাঝে মাঝেই চোখ কেড়ে নেয়,
শিউরে ওঠে গা
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
দু’হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকু
যখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন
তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতন
তীক্ষ্ম ফলা
ছেলেবেলার মতন জেদী
এদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
তোময় আমি আদর করি, পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।


অপমান এবং নীরাকে উত্তর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, নীরা, কেন হেসে উঠলে, কেন
সহসা ঘুমের মধ্যে যেন বজ্রপাত, যেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নীরা, হেসে উঠলে, সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে কেন সাক্ষী কেন বন্ধু কেন তিনজন কেন?
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে সাক্ষী রইলো বন্ধু তিনজন!
একবার হাত ছুঁয়েছি সাত কি এগারো মাস পরে ঐ হাত
কিছু কৃশ, ঠাণ্ডা বা গরম নয়, অতীতের চেয়ে অলৌকিক
হাসির শব্দের মতো রক্তস্রোত, অত্যন্ত আপন ঐ হাত
সিগারেট না-থাকলে আমি দু’হাতে জড়িয়ে ঘ্রাণ নিতুম
মুখ বা চুলের নয়, ঐ হাত ছুঁয়ে আমি সব বুঝি, আমি
দুনিয়ার সব ডাক্তারের চেয়ে বড়, আমি হাত ছুঁয়ে দূরে
ভ্রমর পেয়েছি শব্দে, প্রতিধ্বনি ফুলের শূন্যতা–
ফুলের? না ফসলের? বারান্দার নিচে ট্রেন সিটি মারে,
যেন ইয়ার্কির
টিকিট হয়েছে কেনা, আবার বিদেশে যাবো সমুদ্রে বা নদী…
আবার বিদেশে,
ট্রেনের জানালায় বসে ঐ হাত রুমাল ওড়াবে।
রাস্তায় এলুম আর শীত নেই, নিশ্বাস শরীরহীন, দ্রুত
ট্যাক্সি ছুটে যায় স্বর্গে, হো-হো অট্টহাস ভাসে ম্যাজিক-নিশীথে
মাথায় একছিটে নেই বাষ্প, চোখে চমৎকার আধো-জাগা ঘুম,
ঘুম! মনে পড়ে ঘুম, তুমি, ঘুম তুমি, ঘুম, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন ঘুম
ঘুমোবার আগে তুমি স্নান করো? নীরা তুমি, স্বপ্নে যেন এরকম ছিল…
কিংবা গান? বাথরুমে আয়না খুব সাঙ্ঘাতিক স্মৃতির মতন,
মনে পড়ে বস স্টপে? স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্নে–স্বপ্নে, বাস-স্টপে
কোনোদিন দেখা হয়নি, ও সব কবিতা! আজ যে রকম ঘোর
দুঃখ পাওয়া গেল, অথচ কোথায় দুঃখ, দুঃখের প্রভূত দুঃখ, আহা
মানুষকে ভূতের মতো দুঃখে ধরে, চৌরাস্তায় কোনো দুঃখ নেই, নীরা
বুকের সিন্দুক খুলে আমাকে কিছুটা দুঃখ বুকের সিন্দুক খুলে, যদি হাত ছুঁয়ে
পাওয়া যেত, হাত ছুঁয়ে, ধূসর খাতায় তবে আরেকটি কবিতা
কিংবা দুঃখ-না-থাকার-দুঃখ… ভালোবাসা তার চেয়ে বড় নয়!


“প্রেমিকা”
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে
ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায়
ছাদের ঘরে
কবিতা আমার জামার বোতাম ছিঁড়েছে অনেক
হঠাৎ জুতোর পেরেক তোলে!
কবিতাকে আমি ভুলে থাকি যদি
অমনি সে রেগে হঠাৎ আমায়
ডবল ডেকার বাসের সামনে ঠেলে ফেলে দেয়
আমার অসুখে শিয়রের কাছে জেগে বসে থাকে
আমার অসুখ কেড়ে নেওয়া তার প্রিয় খুনসুটি
আমি তাকে যদি
আয়নার মতো
ভেঙ্গে দিতে যাই
সে দেখায় তার নগ্ন শরীর
সে শরীর ছুঁয়ে শান্তি হয় না, বুক জ্বলে যায়
বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়…..


তুমি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভূরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশের মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করোছো অসীম।
বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনও ভাবি অপার্থিব কিনা।
সারাদিন পৃথিবীকে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে সি’র জানি তুমি দেবে ক্ষমা।
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কার মুখর
তোমার সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখে জয়ের স্বাক্ষর।
যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্পূটে
অসি’র অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।


নীরার অসুখ
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের
বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়-
নীরা আজ ভালো আছে?

গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ
মানুষের মুখে মুখে রটে যায়
নীরার খবর
বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়,
নীরা আজ খুশি!

হঠাৎ উদাস হাওয়া এলোমেলো
পাগলা ঘন্টি বাজিয়ে
আকাশ জুড়ে খেলা শুরু করলে
কলকাতার সব লোক মৃদু
হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ
বেড়াতে গিয়েছে।

আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ।
হঠাৎ ট্রামের পেটে ট্যাক্সি ঢুকে নিরানন্দ জ্যাম চৌরাস্তায়
রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো,
বিরক্ত মুখোস
সমস্ত কলকাতা জুড়ে ক্রোধ আর ধর্মঘট,
শুরু হবে লণ্ডভণ্ড
টেলিফোন পোস্টাফিসে আগুন জ্বালিয়ে
যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে–
আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি,
আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি,
নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও,
আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী
নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার
বলো দেখি ধাঁধার উত্তর!

অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে,
মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে, সাইকেলের
সঙ্গে টেম্পো, মোটরের সঙ্গে রিক্সা
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার
রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ
বলে ওঠে,
বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না!


চোখ ঢেকে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যে যেমন জীবন কাটায়
তার ঠিক সেই রকম এক-একটি পোশাক রয়েছে
আলো ও হাওয়ার মধ্যে লুটোপুটি খেয়ে কে যে
আনন্দ-ভিখারী
উড়ুনি ভিজিয়ে সেও বিধধংসী নদীর থেকে
শান্তি চেয়েছিল
সহসা বিদ্যুত-স্পর্শে চোখ ঢেকে আমিও একদা
অচেনা প্রান্তরে একা ছন্নছাড়া, সমূলে দেখেছি
দিগম্বর মৃত্যু স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে ।


যদি নির্বাসন দাও
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূম
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘুরে
লুঠেরা, ফেরারী ।
শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর,
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্পোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল–
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পারে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক ?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলার ওড়াওড়ি ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো… ।


দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি বারান্দায়
অহঙ্কার তোমাকে মানায় না
তুমি যে-কোনো নারী
যে-কোন বারান্দা থেকে
সন্ধ্যার শিয়রে
মাথা রেখে আছো?

তুমি তো আমারই শুধু ,দূর থেকে দেখা
শুকনো চুল, ভিজে মুখ, করতলে মসৃন চিবুক
তুমি নারী, অহঙ্কার তোমাকে মানায় না—
যে তোমাকে দেখে, সে-ই তোমাকে সুন্দর করে
দ্রষ্টা যে, ঈশ্বরও সে।
তোমার নিঃসঙ্গ রূপ মেশে বাতাসের হাহাকারে ।


একটি কথা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটি কথা বাকি রইলো থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।
ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাশা
বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছুই না
রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া
রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা।
বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছু না
একটি কথা বাকি রইল, থেকেই যাবে।


কথা আছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি,
টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি,
ওপাশে শাড়ির পাড়ে দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ,
দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ,
একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের
কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।


উত্তরাধিকার
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর
. ফুসফুস-ভরা হাসি
দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হ’য়ে শুয়ে থাকা
এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভ’রে নাও আমার অবেলা
. আমার দুঃখবিহীন দুঃখ ক্রোধ শিহরণ
নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছুল আভরণ
জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানালার পাশে
. বালিকার প্রতি বারবার ভুল
পরুষ বাক্য, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, ছুরির ঝলক
অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মত আর যা-কিছুর
. বুক চিরে দেখা
আত্মহনন, শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত
একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী —
এ-সবই আমার পুরোনো পোষাক, বড় প্রিয় ছিল, এখন শরীরে
আঁট হয়ে বসে, মানায় না আর
তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও
অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার
তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয় |


সেদিন বিকেলবেলা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সাতশো একান্নতম আনন্দটি পেয়েছি সেদিন
যখন বিকেলবেলা মেঘ এসে
ঝুঁকে পড়েছিল
গোলাপ বাগানে
এবং তোমার পায়ে ফুটে গেল লক্ষ্মীছাড়া কাঁটা!
তখন বাতাসে ছিল বিহ্‌বলতা, তখন আকাশে
ছিল কৃষ্ণক্লান্তি আলো,
ছিল না রঙের কোলাহল
ছিল না নিষেধ-
অতটুকা ওষ্ঠ থিকে অতখানি হাসির ফোয়ারা
মন্দিরের ভাস্কর্যকে ম্লান করে নতুন দৃুশ্যটি।

এর পরই বৃষ্টি আসে সাতশো বাহান্ন সঙ্গে নিয়ে
করমচা রঙের হাত, চিবুকের রেখা
চোখে চোখ
গোলাপ সৌরভ মেশা প্রতিটি নি:শ্বাস, যত্ন করে
জমিয়ে রাখার মতো-
সম্প্রতি ওল্টানো পদতলে
এত মায়া, বায়ু ধায় ন’শো ঊনপঞ্চাশের দিকে
নগ্ন প্রকৃতির
এত কাছাকাছি আর কখনো আসি নি মনে হয়
জীবন্ত কাঁটার কাছে হেরে যায় গোপন ঈশ্বর
রূপের সহস্র ছবি, বা আনন্দ একটি শরীরে?


কবিতা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্নে দেখেছি যে তুমি
তোমার বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেছো
এখনো কি সময় আছে তোমার জীবন্ত শরীর স্পর্শ করার
এবং যে ওষ্ঠ থেকে আমার অতি প্রিয় স্বর জন্ম নেয়
সেখানে চুম্বন দেবার?…
আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে হয়তো
আমার পক্ষে আর জাগাই সম্ভব হবে না
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোই, আমার শরীর সব
রকম জীবন ও ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত……
আমি তোমার ভুরু ছুঁতে পারি, ওষ্ঠ ছুঁতে পারি এত কম……
আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি, হেঁটেছি,
কথা বলেছি।
শুয়েছি তোমার ছায়ার সঙ্গে……


ঘুরে বেড়াই
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তোমার পাশে, এবং তোমার ছায়ার পাশে
ঘুরে বেড়াই
তোমার পোষা কোকিল এবং তোমার মুখে
বিকেলবেলা রোদের পাশে
ঘুরে বেড়াই
তোমার ঘুমের এবং তোমার যখন তখন অভিমানের
অর্থ খুঁজি অভিধানে
ঘুরে বেড়াই ঘুরে বেড়াই
গাছের দিকে মেঘের দিকে
বেলা শেষের নদীর দিকে
পথ চেনেনা পথের মানুষ
ঘুরে বেড়াই ঘুরে বেড়াই
মেলা শেষের ভাঙা উনুন ছাইয়ের গাদায়
ল্যাজ গুটানো একলা কুকুর
পুকুর পাড়ে মাটির খুরি, সবুজ ফিতে
ঘুরে বেড়াই ঘুরে বেড়াই
তোমার পাশে এবং তোমার ছায়ার পাশে
ঘুরে বেড়াই ।


অন্যলোক
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যে লেখে, সে আমি নয়
কেন যে আমায় দোষী কর !
আমি কি নেকড়ের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে ছিড়েছি শৃঙ্খল ?
নদীর কিনারে তার ছেলেবেলা কেটেছিল
সে দেখেছে সংসারের গোপন ফাটল
মাংসল জলের মধ্যে তার আয়না খুঁজেছে, ভেঙেছে ।
আমি তো ইস্কুলে গেছি, বই পড়ে প্রকাশ্য রাস্তায়
একটা চাবুক পেয়ে হয়ে গেছি শুন্যতায়
ঘোড়সওয়ার ।
যে লেখে সে আমি নয়
যে লেখে সে আমি নয়
সে এখন নীরার সংস্রবে আছে পাহাড়-শিখরে
চৌকশ বাক্যের সঙ্গে হাওয়াকেও
হারিয়ে দেয় দুরন্তপণায়
কাঙাল হতেও তার লজ্জা নেই
এবং ধ্বংসের জন্য তার এত উন্মত্ততা
দূতাবাস কর্মীকেও সে খুন করতে ভয় পায়না ।
সে কখনো আমার মতন বসে থাকে
টেবিলে মুখ গুঁজে ?


যে-যাই বলুক
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যে-যাই বলুক, আমার ভীষণ
বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে
সন্ধেবেলায় নীলচে আলোয় পথ ঘুরে যায় মোমিনপুরে
আমি তখন কোন প্রবাসে, বেঁচে থাকার থেকেও দূরে
ঘুরে মরবো ! নরম হাত
ঠোঁট ছোঁবে না, চোখ ছোঁবে না ?
যে-যাই বলুক , আমার ভীষণ
বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।

মধ্য নিশীথ আমায় ডেকে দেখিয়েছিল হাস্নুহেনা
সকালবেলার রোদে আমার
শিশুকালের স্নেহ মমতা
হাওয়ায় ওড়ে । শুন্য বনে
বলেছিলাম গোপন কথা
কেউ শোনেনি, তবু আমার স্বপ্ন ঘোরে আলোক মেঘে
যে যাই বলুক, আমার ভীষণ
বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে ।

কে জালে আগুন, কে ছুটে যায় ক্রুদ্ধ বেগে !
কে রসাতল জাগাতে চায়,
কার নিশ্বাস ছুরি ঝলকায় ?
তুমিও ভালোবেসেছিলে না ? তবুও কেন মরণ খেলায়
এত আনন্দ ! সত্যি বলো তো, এখন আর বাঁচতে চাও না ?
যে-যাই বলুক , আমার ভীষণ বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।


দু’ পাশে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

টেবিলের দুই প্রান্তে মুখোমুখি বসে থাকা, অন্তরীক্ষ চোখে
চোখাচোখি করে আছে
পলক পড়ার শব্দ, শুধু ক্ষণিকের অন্ধকার
চোখের ভাষার কাছে মানুষের কৃতঘ্ন সভ্যতা থেমে থাকে ।
আমিতো বুঝিনা ঐ ভাষা, বুঝি না নিজেরই চোখ কোন কথা
বলে, তবু চেয়ে আছি
পরষ্পর দুর্বোধ্যতা, ঢেকে রাখা বুক থেকে ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস-
এর চেয়ে কত সোজা আঙুল স্পর্শের যোগাযোগ,
কাঁধের ওপরে রাখা
অমার্জিত হাত
শরীর সরব হলে দরজা-জানালা সেই ভাষা বোঝে
মূহুর্তের মর্ম বোঝে আয়ু
তবু আমি ভাষা-ভ্রান্ত, বিমুর্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি ।


চোখ নিয়ে চলে গেছে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই যে বাইরে হু হু করা ঝড়, এর চেয়ে বেশি
বুকের মধ্যে আছে
কৈশোরজুড়ে বৃষ্টিবিলাস, আকাশে থাকুক যত মেঘ,
যত ক্ষণিকা
মেঘ উড়ে যায়
আকাশ ওড়েনা
আকাশের দিকে
উঠছে নতুন সিড়ি
আমার দু বাহু একলা মাঠের জারুলের ডালপালা
কাচ ফেলা নদী, যেন ভালোবাসা
ভালোবাসবার মতো ভালোবাসা-
দু’দিকের পার ভেঙে
নারীরা সবাই ফুলের মতন, বাতাসে ওড়ায়
যখন তখন
রঙ্গিন পাপড়ি
বাতাস তা জানে, নারীকে উড়াল দিয়ে নিয়ে যায়
তাই আমি আর প্রকৃতি দেখি না,
প্রকৃতি আমার চোখ নিয়ে চলে গেছে !


এক জীবন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

শামুকের মতো আমি ঘরবাড়ি পিঠে নিয়ে ঘুরি
এই দুনিয়ায় আমি পেয়ে গেছি অনন্ত আশ্রয়
এই রৌদ্র বৃষ্টি, এই শতদল বৃক্ষের সংসার
অস্থায়ী উনুন, খুদ কুঁড়ো-
আবার বাতাসে ওড়ে ছাই
আমি চলে যাই দূরে, আমি তো যাবোই,
জন্ম-মৃত্যু ছাড়া আমি কোনো সীমানা মেনেছি ?
এ আকাশ আমারই নিজস্ব
আমার ইচ্ছেয় হয় তুঁতে
নারী ও নদীরা সব আমারই নিলয়ে এসে
পা ছড়িয়ে স্মৃতিকথা বলে
চমৎকার গোপান আরামে কাটে দিন
আর সব রাত্রিগুলি নিশীথ কুসুম হয়ে ঝরে যায়……


সারা দুনিয়ায়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সারা দুনিয়ায় এক দুর্নিবার চ্যাঁচামেচি, কেড়ে নিতা হবে !
হবেই তো !
যে না নেয়, তার মৃত্যু গাছের ডগায়!
সারা দুনিয়ায় আজ অবিশ্রান্ত হুড়োহুড়ি ! কাল যেন শেষ
তার চিহ্ন,
সূর্যাস্তের লাল আভা, পাশে পোড়া ছাই !
সারা দুনিয়ায় আজ লজ্জাহীন রেষারেষি, কে পাবে অগ্রিম
হাত খোলা,
যে-হাত দেয়না কিছু, শুধু সব নেবে !
সারা দুনিয়ায় আজ স্বার্থকতা-মৃত্যুপণ, তারই নাম সুখ
দেখা যায়
নদীর অপর তীরে তার অন্য ভাই বসে আছে !
সকলেই যা চেয়েছে, ধরা যাক একদিন তাই পেয়ে গেল
তবু দেখো,
কবিতা লেখার জন্য ক’জন মানুষ শুধু,
কিছু চাইবেনা !


আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কি মানুষজন্ম ? নাকি শেষ
পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা ! প্রতি সন্ধেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি – তার ভেতরের কুকুরটা দেখব বলে। আমি আক্রশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে; খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে –
(ও গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই !)

আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়েয়েছি দৃশ্যলোক
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি । নিখিলেশ, তুই একে
কী বলবি? আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে
বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশী ছিল কি না ।
আমি ফুলের পাশে ফুল হয়ে ফুটে দেখেছি, তাকে ভালবাসতে পারি না ।
আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।

নিখিলেশ, আমি এই রকম ভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবন বদল করে কোনো লাভ হলো না আমার – এ কি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো দুব সাঁতার ? – অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন ? অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত
দম্পতির পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা ? কেননা সময় নেই,
আমার ঘরের
দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয় । মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে আছে । ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বাণ্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি । আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি …, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিলো না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে । তবু, ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ রকম জলচেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাতড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর । ইঁদুর নয় মূষিক ? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক ? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই
অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না । আমার পূজা ও নারী হত্যার ভিতরে
বেজে উঠে সাইরেন । নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো
কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের । আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় এক পলক সত্যি চোখ । এ রকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশি নেই আর ।


উনিশশো একাত্তর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মা, তোমার কিশোরী কন্যাটি আজ নিরুদ্দেশ
মা, আমারও পিঠোপিঠি ছোট ভাইটি নেই
নভেম্বরে দারুণ দুর্দিনে তাকে শেষ দেখি
ঘোর অন্ধকারে একা ছুটে গেল রাইফেল উদ্যত।
এখন জয়ের দিন, এখন বন্যার মত জয়ের উল্লাস
জননীর চোখ শুকনো, হারান কন্যার জন্য বৃষ্টি নামে
হাতখানি সামনে রাখা, যেন হাত দর্পন হয়েছে
আমারো সময় নেই, মাঠে কনিষ্ঠের লাশ খুঁজে ফিরি।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
একা একা হাহাকার; আজিজুর, আজিজুর, শোন—
আমার হলুদ শার্ট তোকে দেবো কথা দেওয়া ছিল
বেহেস্তে যাবার আগে নিলিনা আমার দেহঘ্রাণ?
লিকলিকে লম্বা ছেলে যেন একটা চাবুক, চোয়ালে
কৈশোরের কাটা দাগ, মা’র চোখে আজও পোলাপান
চিরকাল জেদী ! বাজির গহবর ফেলে নদী থেকে মাটি তুলে আনতো
মশার জ্বালিয়ে আমি ভাগাড়ের হাড়মুন্ডে চিনবো কি তাকে?
মা, তোমার লাবণ্যকে শেষ দেখি জুলায়ের তেসরা
শয়তানের তাড়া খেয়ে ঝাঁপ দিল ভরাবর্ষা নদীর পানিতে
জাল ফেলে তবু ওকে টেনে তুললো, ছটফটাচ্ছে যেন
এক জলকন্যা
স্টিমারঘাটায় আমি তখন খুঁটির সঙ্গে পিছমোড়া বাধা ।
ক’টা জন্তু নিয়ে গেল টেনে হিচড়ে, হঠাত লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে
তাকালো সবার চোখে, দৃষ্টি নয়, দারুণ অশনি
ঐটুকু মেয়ে, তবু এক মুহুর্তেই তার রূপান্তর ত্রিকাল-মায়ায়
কুমারীর পবিত্রতা নদীকেও অভিশাপ দিয়ে গেল ।
মা তোমার লাবণ্যকে খুঁজেছি প্রান্তরময়, বাঙ্কারে ফক্সহোলে
ছেঁড়া ব্রা, রক্তাক্ত শাড়ী – লুন্ঠিত সীতার মতো চিহ্ন পড়ে আছে
দূরে কাছে কয়েক লক্ষ আজিজুর অন্ধকার ফুঁড়ে আছে
ধপধপ হাড়ে
কোথাও একটি হাত মাটি খিমচে ধরতে চেয়েছিল।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
বাঁ হাতের উল্টোপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়
কবরে লুকিয়ে ঢোকে ফুলচোর, মধ্য রাত্রে ভেঙে যায় ঘুম
শিশুরা খেলার মধ্যে হাততালি দিয়ে ওঠে, পাখিরাও
এবার ফিরেছে।
(সুনীল)


পাহাড় চূড়ায়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
… কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
… যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই
কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই।

নদীটাও অবশ্য কিনেছিলামি একটা দ্বীপের বদলে।
ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো,
ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।
সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।
শৈশবে দ্বীপটি ছিল আমার বড় প্রিয়।
আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার
কাছে মাপে ছোট লাগলো। প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।
বন্ধুরা বললো, ঐটুকু
একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড়
একটা নদী পেয়েছিস?
খুব জিতেছিস তো মাইরি!
তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।
তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।
নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।
যেমন, বলো তো, আজ
সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?
সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।
শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,
সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!
আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না,
সে জানতো! সবাই জানে।
শৈশবে আর ফেরা যায় না।

এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ
কঠিন পাহাড়।
একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কন্ঠস্বর সেখানে কেউ
শুনতে পাবে না।
আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,
প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-
এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।
হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।
আমাকে ক্ষমা করো।


শীত এলে মনে হয়
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মাঠ থেকে উঠে ওরা এখন গোলায় শুয়ে আছে
সোনালী ফসল, কত রোদ ও বৃষ্টির স্বপ্ন যেন
স্নেহ লেগে আছে
লাউমাচায়, গরু ও গরুর ভর্তা সবান্ধব পুকুরের পাশে
মুখে বিশ্রামের ছবি, যদিও কোমরে গ্যাঁটে ব্যাথা ।

শীত এলে মনে হয়, এবার দুপুর থেকে রাত
মধুময় হয়ে যাবে, যে রকম চেয়েছেন পিতৃপিতামহ
তাদের মৃত্যুর আগে ভেবেছেন আর দুটো বছর যদি…
শীত এলে মনে হয়, এই মাত্র পার হল সেই দু’বছর
এবার সমস্ত কিছু……
শীত চলে যায়, বছর বছর শীত চলে যায়,
সে দুটি বছর আর কখনো আসেনা ।


জনমদুখিনী
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যতদিন ছিলে তুমি পরাধীনা ততদিন ছিলে তুমি সবার জননী
এখন তোমাকে আর মা বলে ডাকেনা কেউ
লেখেনা তোমার নামে কবিতা
বুক মোচড়ানো সুরে সেইসব গান
গুপ্ত কুঠুরিতে মৃদু মোমের আলোর সামনে আবেগের মাতামাতি
জনমদুখিনী মা কোনদিন স্বাধীনা হলেনা
এখন তোমাকে আর ভুলেও ডাকেনা কেউ
আঁকেনা তোমার কোন ছবি
কেউ কারো ভাই নয়, রক্তের আত্মীয় নয়
নদীর এপার দিয়ে, নদীর অপার দিয়ে চলে যায় বিষন্ন মানুষ


নিজের আড়ালে
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখ না
সে খোজে ভ্রমর কিংবা
দিগন্তের মেঘের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
কতকাল না দেখা আকাশ
কতকাল নদী বা ঝর্ণায় আর
দেখে না নিজের মুখ
আবর্জনা, আসবাবে বন্দী হয়ে যায়
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
রমণীর কাছে গিয়ে
বারবার হয়েছে কাঙ্গাল
যেমন বাতাসে থাকে সুগন্ধের ঋণ
বহু দূরের স্মৃতি আবার কখন মুছে যায়
অসম্ভব অভিমানে খুন করে পরমা নারীকে
অথবা সে অস্ত্র তোলে নিজেরই বুকের দিকে
ঠিক যেন জন্মান্ধ তখন
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে


ফেরা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এমনভাবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নাকি
ভিড়ের মধ্যে ভিখারী হয়ে মিশে যাওয়া?
এমন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গ থেকে ধুলোর মর্ত্যে
মানুষ সেজে একজীবন মানুষ নামে বেঁচে থাকা?
সমুদ্রেরও হৃদয় আছে, এই জেনে কি নারীর কাছে
অতলে ডুবে খুঁজতে খুঁজতে টনটনায় চক্ষুস্নায়ু !
কপালে দুই ভুরুর স্বন্ধি, তার ভেতরে ইচ্ছা-বন্দী
আমার আয়ু, আমার ফুল ছেড়ার নেশা,
নদীর জল পাহাড়ে যায়, তুষার-চুড়া আকাশে মেশা
আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসার মুঠোয় ফেরা।


মায়াসুন্দর
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ফণা তোলা সাপের মতন এমন বিচিত্র সুন্দর আর কি আছে
অথচ তা পাখির মতন সুন্দর না !
তারপর সাপ চুপি চুপি ছোবল মারে পাখির বাসায়
রাত্রিতে গড়িয়ে পড়ে কান্না
সুন্দরের মধ্যে প্রচন্ড নিষ্ঠুরতা হা-হা করে
অসহায় পাখি মা একটু দূরে ডানা ঝাপটায়
তার ঠোটে ধরা তখনও একটি প্রজাপতি
পুরো দৃশ্যটি ঝলসে ওঠে যুবতী জ্যোৎস্নায়
অপরূপ দেবদারু গাছটি আরও সুন্দর হয়ে ওঠে
কেননা তার নীচে অপেক্ষমান এক নারী
যে মায়া দর্পনকে প্রশ্ন করেছিলো,
বল তো, আমার চেয়ে অসুখী আর কে আছে
সে জানে তার জন্য আর কেউ আসবেনা
এই অপরূপ মায়ার সন্নিধানে
বিচ্ছেদ আরও মধুর যে।


ভোরবেলার মুখচ্ছবি
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভোরবেলার মুখচ্ছবি কোথায় লুকিয়ে রাখো
সারাদিন?
দিনগুলি রেফ ও র-ফলা দিয়ে লেখা
স্নেহ গলে যায় রোদে, রুমকোপে বেড়ে ওঠে ঝাঁঝ
হাসি হাসি মুখগুলি এ ওর দু’কানে ঢালে বিষ
পাখি নেই, খাঁচাগুলো নেচে যায় অথবা দৌড়ায়
জুতোর তলার ধুলো ধুলো নয় প্রচ্ছন্ন বারুদ
তোমায় দেখিনা কেন, দেখেও চিনিনা—
ভোরবেলার মুখচ্ছবি কোথায় লুকিয়ে রাখো
সারাদিন?


রাগী লোক
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাগী লোকেরা কবিতা লিখতে পারেনা
তারা বড্ড চ্যাঁচায়
গহন সংসারের ম্লান ছায়ায় রাগী লোকেরা অত্যন্ত নিঃসঙ্গ
তারা নিজের কন্ঠস্বর শুনতে ভালোবাসে।
পাহাড়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়া জলপ্রপাতের কাছে
আমি একজন রাগী লোককে দেখেছিলাম
তার বাঁকা ভুরু ও উদ্ধত ভঙ্গিমার মধ্যেও কি অসহায়
একজন মানুষ–
নদীর গতিপথ কেন খালের মতো সরল নয়
এ নিয়ে লোকটা খুব রাগারাগি করছিল!
হাতে এক গোছা চাবি
তবু তালা খোলার বদলে সে পৃথিবীর সব
দরজা ভেঙে ফেলতে চায়-
ঐ লোকটি কোনদিন কবিতা লিখতে পারবেনা
এই ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব!
পাহাড় ও জলপ্রপাতের পাশে সেই
বিশাল সুমহান প্রকৃতির মধ্যে
বাজে পোড়া শুকনো গাছের মতন দাঁড়িয়ে রইলো
একজন রাগী মানুষ।


এখন
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দারুণ সুন্দর কিছু দেখলে আমার একটু একটু
কান্না আসে।
এমন আগে হতনা,
আগে ছিল দুরন্ত উল্লাস,
আগে এই পৃথিবীকে জয় করে নেবার বাসনা ছিল
এখন মনে হয় আমার এই পৃথিবীটা
বিলিয়ে দেই সকলকে
পরশুরামের মত রক্তস্নান সেরে
চলে যাই দিগন্ত কিনারে
যত সব মানুষকে চিনেছি, তাদের ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়
নাও, যার যা খুশি নাও,
শিশির ভেজা মাঠে শুয়ে থাক কিছু সুখী মাথা ।


দুঃখ
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একসময় আমি দুঃখের কথা দুঃখের সুরে বলতাম
তখন দুঃখকে চিনতামনা
কিংবা দুঃখ ছিলনা তখন, আকস্মিক
বৃষ্টিতে দুলত বিষাদের পাতলা পর্দা
পৌণে তিনশো মাইল দূরে ছুটে গেছে দীর্ঘশ্বাস
অসংখ্য নীলখাম জঠরে নিয়ে গেছে
দুপুরবেলার অভিমান
ছেড়া চটি পায়ে দিনরাত ঘুরে ঘুরে ,
সঙ্গে বহন করতাম খালি প্যাকেটের মতন
খুনখারাপ
হীরন্ময় ভোরবেলাগুলি গায়ে লেগে থাকত
হৃদয়-শোণিত
সুখী ছিলাম, সুখী ছিলাম, ভীষণ সুখী ছিলামনা?
এখন কেউ এসে দেখুক
আমার পরিচ্ছন্ন মুখ, আমার মসৃণ জীবনযাপন
চায়ের কাপের পাশে সিগারেট সমৃদ্ধ হাত
নিশীথ যুবনিকা তছনছ করা সৌখিন দাপাদাপি
যে-কেউ দেখে ভাববে আমি দুঃখকে চিনিইনা……


দেখা
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ভালো আছো?
– দেখো মেঘ বৃষ্টি আসবে।
ভালো আছো?

– দেখো ঈশান কোনের আলো, শুনতে পাচ্ছো ঝড়?
ভালো আছো?
-এইমাত্র চমকে উঠলো ধপধপে বিদ্যুৎ ।
ভালো আছো?
– তুমি প্রকৃতিকে দেখো।
– তুমি প্রকৃতি আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছো।
আমিতো অণুর অণু, সামান্যর চেয়েও সামান্য।
তুমি জ্বালাও অগ্নি, তোল ঝড়, রক্তে এতো উন্মাদনা।
– দেখো সত্যিকার বৃষ্টি, দেখো সত্যিকার ঝড়।
তোমাকে দেখাই আজোশেষ হয়নি,
তুমি ভালো আছো


বুকে যে ঝর্ণার উৎস
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বুকে যে ঝর্ণার উৎস সে কোন গভীরে
হারায়, অথবা কোন ভ্রান্ত মরুপথে
বৃষ্টির ফোটার মতো শুণ্যে ঘুরে ফিরে
ফিরে যায় সায়াহ্নের জয়দৃপ্ত রথে।
আমিও দেখিনি তাকে, নিজের মুকুর
মনে হয় ভেঙে ভেঙে ছড়িয়েছি ভুলে
কখনো নিভৃতে শুনি যে নির্ঝর সুর
চিরকাল অদেখা সে সিংহদার খুলে
হৃদয়ের অন্ধকার সাতমহলায়
অনেক ঘুরেছি আমি জোনাকীর মতো,
দেখেছি স্বপ্নের নামে স্মৃতিতে হারায়
যা কিছু কৃপণ চোখে খুঁজি ক্রমাগত।


শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সর্বত্র