আসাদ চৌধুরীর কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা


আসাদ চৌধুরী (জন্মঃ ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক। তিনি মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনা ও চমৎকার আবৃত্তির জন্যও জনপ্রিয়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর পদচারণা। কবিতা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তিনি একজন বাংলা একাডেমী পুরস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি। তাঁর কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত।


আসাদ চৌধুরীর কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা

রিপোর্ট ১৯৭১

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।



শহীদদের প্রতি

তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল ?
ঘৃণার ছিল ?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল ?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কারনিসে কি ধুসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?



প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহী 

মাত্র পা রেখেছ কলেজে সেই বার,
শব্দ দিয়ে গাঁথো পূর্ব সীমান্তে
সাহসী ‘সীমান্ত’।
দ্বিজাতিতত্ত্বের লোমশ কালো থাবা
শ্যামল সুন্দর সোনার বাংলাকে
করেছে তছনছ, গ্রাম ও জনপদে
ভীতির সংসার, কেবল হাহাকার।
টেবিলে মোমবাতি কোমল কাঁপা আলো
বাহিরে বৃষ্টির সুরেলা রিমঝিম_
স্মৃতির জানালায় তোমার মৃদু টোকা।
রূপার সংসারে অতিথি সজ্জন
শিল্পী কতজন হিসেব রাখিনি তো!
স্মরণে ওস্তাদ_ গানের মমতাজ।
দারুণ উচ্ছ্বাস, সামনে চা’র কাপ
প্রধান অতিথি তো আপনি, বলবেন_
কিন্তু তার আগে এ ঘোর বরষায়
সমানে বলছেন নিজের সব কথা।
ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে
ভাষণ, প্রতিবাদ_ যাত্রা, থিয়েটার
রমেশ শীল আর আবুল ফজলের,
কলিম শরাফীর সাহসী আচরণ
কী হলো? কী হয়েছে? আজ তো আপনার
মুখে যে খৈ ফোটে! স্বপ্ন-স্মৃতি দোলে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর খুঁড়ছো
সঙ্গী বেড়ে চলে, সঙ্গে সঙ্গীত
নাটক, সাহিত্য, সাম্প্রদায়িকতা
ঘেঁষতে পারছে না, আপনি লিখবেন
অমর কবিতাটি জ্বরের ঘোরে, একা
প্রেসের ছোট ঘরে_ আঙুল কাঁপছিল?
কর্ণফুলী সেও জোয়ারে ফুঁসছিল_
নদীরা চঞ্চল সাগরে মিশবে যে।
ঢাকা ও কলকাতা, সুচক্রদণ্ডী
কুনতি, কুমিল্লা কোথায় নেই কবি?
সেই তো শুভ শুরু, শহীদ মিনারের
আকুল হাতছানি, মিশেছে সাভারে
অটল স্থাপনায়।
এই কি শেষ তবে?
প্রতিটি অর্জন ধুলায় মিশে যায়,
নতুন উৎপাত মৌলবাদ আর
জঙ্গীবাদ আসে, পশ্চিমের থেকে,
মানবাধিকারের লালিত বাণী যেনই
স্বেচ্ছাচারিতার প্রতাপ চৌদিকে_
দৃপ্ত পায়ে কবি কাতারে মিছিলের
কারফু কার ফুঁতে ওমন ক’রে ভাগে?
কবি কি দেখছেন প্রমিত বাংলার
করুণ হালচাল? ভাষণে, সংলাপে
সিনেমা, থিয়েটারে ছোট্ট পর্দার
যাদুর বাক্সতে এ কোন বাংলার
মাতম ছড়াছড়ি? হায় রে মূলধারা!
প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহী
এমন দুর্দিনে তাই তো মনে পড়ে
তোমার হাসি মুখ, তোমার বরাভয়
ভীরুতা চারদিকে, তুমিও নেই পাশে।




শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন সর্বত্র