
প্রতিবেশীর হক বা অধিকার সম্পর্কে সজাগ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। ইসলাম
প্রতিবেশীর হককে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ
মানুষই বর্তমানে প্রতিবেশীর হক ও অধিকার সম্পর্কে বে-খবর। প্রতিবেশীর হক
সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতার উপলব্ধি থেকে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন ও সজাগ করার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। তাই প্রতিবেশীর হক, প্রতিবেশী কারা, প্রতিবেশীদের
বিষয়ে ইসলাম কি বলে,ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
আশা করি প্রবন্ধটি পড়ে একজন পাঠক উপকৃত হবেন এবং প্রতিবেশীর হক ও অধিকার
সম্পর্কে জানতে পারবেন।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ বা দলবদ্ধ হয়ে পরস্পরে মিলেমিশে বসবাস করতে হয়। একাকী বসবাস করতে
পারেনা। আর ‘যারা আমাদের আশে পাশে বসবাস করে তারাই আমাদের প্রতিবেশী’। সমাজে বাস করতে হলে এক মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক জরুরি। ইসলামে এ জন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে সু-সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সব কিছু বদলানো গেলেও প্রতিবেশী বদল করা যায় না। এ বাস্তবতাকে মনে রেখে পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণের যে বাধ্যবাধকতা ইসলামে আরোপ করা হয়েছে তা দৃষ্টান্তস্থানীয়।
রসুল (সা.)-এর কাছে এসে এক ব্যক্তি বলল- কি আমল অনুসরণ করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে তা যেন তিনি বাতলে দেন। রসুল (সা.) বললেন পরোপকারী হও। ওই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে বুঝব আমি পরোপকারী? রসুল (সা.) বললেন, তোমার প্রতিবেশী যদি বলে তুমি পরোপকারী, তবে তুমি পরোপকারী। আর যদি সে বলে তুমি অন্যায়কারী তবে তুমি অন্যায়কারী।
কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ
প্রতিবেশী কে?
প্রতিবেশী
বলতে মুসলিম, কাফের, নেক বান্দা,ফাসেক, বন্ধু, শত্রু,পরদেশী, স্বদেশী,
উপকারী, ক্ষতিসাধনকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, নিকটতম বা তুলনামূলক একটু
দূরেরপ্রতিবেশী সবাই অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিবেশী গণ্য হওয়ার সীমাঃ
কত দূর এলাকার অধিবাসীরা প্রতিবেশী হিসাবে গণ্য হবে এ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। যেমন-
(১)
হাসান (রাঃ) বললেন, أربعين داراً أمامه، وأربعين خلفه، وأربعين عن يمينه،
وأربعين عن يساره. অর্থাৎ নিজের ঘর হ’তে সম্মুখের চল্লিশ ঘর, পশ্চাতের
চল্লিশ ঘর, ডান দিকের চল্লিশ ঘর এবং বাম পার্শ্বের চল্লিশ ঘর’ (এর অধিবাসী
লোকজনই প্রতিবেশী হিসাবে গণ্য)।
(২) কেউ বলেন, চারিদিকের দশ ঘর প্রতিবেশী হিসাবে গণ্য হবে।
(৩) কেউ বলেন, যে ব্যক্তি ডাক শুনতে পায় সে প্রতিবেশী।
(৪) যে অতি নিকটে বা পাশাপাশি থাকে সে প্রতিবেশী।
(৫) কেউ বলেন, প্রতিবেশী হচ্ছে যারা একই মসজিদে সমবেত হয়।
প্রতিবেশীর প্রকারঃ
আর প্রতিবেশী সাধারণত তিন শ্রেণীর হয়ে থাকে এবং তাদের হকও বিভিন্ন দিকে লক্ষ করেকম বেশী হয়ে থাকে।
১. যার এক দিক থেকে হক থাকে। সে হল, অনাত্মীয় বিধর্মী প্রতিবেশী।এ ব্যক্তির হক শুধু প্রতিবেশী হওয়ার ভিত্তিতে।
২.
যার দুই দিক থেকে হক থাকে। সে হল, মুসলিম প্রতিবেশী, যার সাথে আত্মীয়তার
কোনো সম্পর্ক নেই। এ ব্যক্তির হক প্রতিবেশী এবংমুসলিম হওয়ার দিক থেকে।
৩. যার তিন দিক থেকে হক থাকে। সে হল, মুসলিম আত্মীয়প্রতিবেশী। এ ব্যক্তির হক প্রতিবেশী, মুসলিম ও আত্মীয় হওয়ার দিক থেকে।
তবে
প্রত্যেকশ্রেণীই যেহেতু প্রতিবেশী তাই প্রতিবেশীর সকল হকের ক্ষেত্রে সবাই
সমান হকদার। আর প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা, বিপদে আপদে এগিয়ে যাওয়া, একে
অপরের সুখ-দুঃখের শরিকহওয়া, হাদিয়া আদান প্রদান করা, সেবা শুশ্রূষা করা,
প্রতিবেশীর কেউ মারা গেলে সান্ত্বনাদেওয়া, কাফন দাফনে শরিক হওয়া, একে
অপরের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার
দেওয়া, প্রতিবেশীর কষ্টের কারণ হয় এমন সব ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা
ইত্যাদি সবই একজন মুমিনের স্বভাবজাত বিষয় হওয়া উচিত।
প্রতিবেশীর হক কুরআনে
আল্লাহ
তাআলা আলকুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহর ইবাদাত ও তারসাথে
কাউকে শরিক না করা-এই বিধানের সাথে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের
হক। তার মধ্যে রয়েছে মাতা পিতার হক, আত্মীয় স্বজনের হক, এতীমের হক
ইত্যাদি। এসব গুরুত্বপূর্ণ হকের সাথেই আল্লাহ প্রতিবেশীর হককে উল্লেখ
করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রতিবেশীর হককে আল্লাহ কত গুরুত্ব দিয়েছেন
এবং তা রক্ষা করা আমাদের জন্য কতজরুরি। আল্লাহ বলেছেন, (অর্থ) তোমরা
আল্লাহর ইবাদাত কর এবং কোনো কিছুকে তারসাথে শরিক করো না। এবং পিতা-মাতা,
আত্মীয়-স্বজন, এতীম, অভাবগ্রস্থ, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী,
সংগী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর।নিশ্চয়
আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।
উত্তম প্রতিবেশী কে?
এ
প্রশ্নের সহজ উত্তর হল, যে প্রতিবেশীর সাথে ভালো আচরণ করে এবং প্রতিবেশীর
সকলহক যথাযথভাবে আদায় করে। ফলে প্রতিবেশী তার উপর সন্তুষ্ট থাকে এবং
আল্লাহ্ও তারউপর সন্তুষ্ট থাকেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র রা. বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন, ... যে স্বীয়
প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো সেই সর্বোত্তম প্রতিবেশী। (সহীহইবনে খুযাইমা হা.
২৫৩৯; শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হা. ৯৫৪১; মুসনাদে আহমদ হা. ৬৫৬৬)
প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা ঈমানের দাবি
হযরত
ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না
খেয়ে থাকে। (মুসনাদেআবু ইয়ালা, হাদীস ২৬৯৯; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২)
এখানে
একটি বিষয় লক্ষণীয়, অনেক প্রতিবেশীই এমন আছে, যাদের দেখে বোঝার উপায়নেই
যে, তারা অভাবে দিন কাটাচ্ছে। আবার আমার কাছে কখনো চাইবেও না। কুরআন
মাজীদে এদেরকে ‘মাহরূম’ বলা হয়েছে, সূরা যারিয়াতে আল্লাহ তায়ালা
বলেন,(অর্থ) এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও মাহরূমের (বঞ্চিতের) হক।
(সূরা যারিয়াত : ১৯) এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য, নিজে থেকে তাদের খোঁজ খবর
রাখা এবং দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন পন্থা অবলম্বন করা, যাতে সে লজ্জা না পায়।
এজন্যইতো যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা বলে দেয়াজরুরি নয় যে, আমি তোমাকে
যাকাত দিচ্ছি; বরং ব্যক্তি যাকাতের যোগ্য কি না এটুকু জেনে নেয়াই যথেষ্ট।
আর
আমি প্রতিবেশীর প্রয়োজন পুরা করব তাহলে আল্লাহ আমার প্রয়োজন মিটিয়ে
দিবেন এবং আমার সহায় হবেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন
পুরা করে আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরা করেন। (সহীহ বুখারী,হাদীস ২৪৪২; সহীহ
মুসলিম, হাদীস২৫৮০)
প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ
প্রতিবেশী
আমার জীবনের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তার সাথে আমার আচরণ সুন্দর হবে তা কিবলে
বোঝাতে হয়? আর আমি যদি মুমিন হই তাহলে তো তা আমার ঈমানের দাবি। হযরত আবু
শুরাইহ্ রা. বলেন, আমার দুই কান শ্রবণ করেছে এবং আমার দুই চক্ষু প্রত্যক্ষ
করেছে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে আল্লাহর
প্রতি ঈমান রাখে এবংআখেরাতে বিশ্বাস রাখে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীকে সম্মান
করে। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে ‘সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ
করে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮)
প্রতিবেশী রোগীর সেবা করাও ইবাদত
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাকে দেখতে যাওয়া ও তার অবস্থা জিজ্ঞেস করা মুস্তাহাব। যদি রুগ্ণ ব্যক্তির দেখাশোনা করার মতো তার কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকে, তাহলে সর্বসাধারণের মধ্যে তার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিদের ওপর তার সেবাশুশ্রুষা করা ফরজেকেফায়া।
রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের হক পাঁচটি -
১। সালামের জবাব দেয়া, ২। রোগীকে দেখতে যাওয়া, ৩। জানাজায় শরিক হওয়া,
৪। দাওয়াত কবুল করা, ৫। হাঁচির জবাব দেয়া। (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত শরিফ : হাদিস নম্বর ১৫২৪)।
হজরত বারা ইবনে আজিব রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের সাতটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন -
প্রথম, রোগীর শুশ্রুষা করা; দ্বিতীয়, জানাজার পশ্চাতে চলা। তৃতীয়, হাঁচিদাতার জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা;
চতুর্থ, দুর্বল মানুষের সাহায্য করা। পঞ্চম, নিপীড়িত ব্যক্তিদের সাহায্য করা; ষষ্ঠ, সালামের প্রচার-প্রসার ঘটানো;
সপ্তম, কসমকারীর কসমকে পুরা করতে সাহায্য করা (বুখারি শরিফ ৭/১১৩ : হাদিস নম্বর ৫৬৩৫)।
সর্বপ্রথম রাসূল সা: যা বলেছেন তা হচ্ছে, রোগীর সেবাযত্ন করা। অসুস্থ ব্যক্তির অসুস্থতার কথা জিজ্ঞেস করা। রাসূলুল্লাহ সা: নিজেও রোগীর সেবাশুশ্রুষা করতেন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: এক অসুস্থ ইহুদি গোলামকে দেখতে গিয়ে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
হাদিয়া আদান-প্রদান
প্রতিবেশীদের
পরস্পরের সুসম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে হাদিয়ার আদান-প্রদান খুবই কার্যকর
পন্থা। এর মাধ্যমে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয় ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা হাদিয়া
আদান-প্রদান কর। এর মাধ্যমে তোমাদের মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি হবে।’ (দ্র. আল
আদাবুল মুফরাদ,বুখারী হাদীস : ৫৯৪)
এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে
হাদিয়া দেওয়ার বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, সামান্য জিনিস হাদিয়া দিতেও
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এক
হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যর
রা.- কেবলেন, হে আবু যর, তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে
দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো। (সহীহ মুসলিম,হাদীস ২৬২৫)
অন্য
হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে এ বিষয়ে
উদ্বুদ্ধ করেবলেছেন, হে মুসলিম নারীগণ! তোমাদের কেউ যেন প্রতিবেশীকে
হাদিয়া দিতে সংকোচবোধনা করে। যদিও তা বকরীর খুরের মত একটি নগন্য বস্ত্তও
হয়। (দ্র. সহীহ বুখারী ৬০১৭)
সুতরাং প্রতিবেশী নারীরাও নিজেদের মাঝে হাদিয়া আদান-প্রদান করবেন।
ভালো কিছু রান্না হলে
আমার
বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে প্রতিবেশীকে না জানালেও রান্নার ঘ্রাণ তো
তাকে জানিয়েদেয়; পাশের বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হচ্ছে। বড়দের কথা বাদ
দিলাম, ঘ্রাণ পেয়ে ছোটদেরমনে তো আগ্রহ জাগবে তা খাওয়ার। সুতরাং তাদের
দিকে লক্ষ্য রেখে ঝোল বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে হোক বা নিজে একটু কম খাওয়ার
মাধ্যমে হোক সামান্য কিছু যদি পাঠিয়ে দিই তাহলে ঐ ছোট্ট শিশুর মনের ইচ্ছা
যেমন পুরা করা হবে তেমনি আল্লাহও খুশি হবেন। যা আমার রিযিকে বরকতের কারণ
হবে ইনশাআল্লাহ। যে খাদেম খানা তৈরি করল তাকেওখানায় শরিক করার কথা হাদীসে
এসেছে। কারণ এ খাবার প্রস্ত্তত করতে গিয়ে সে এর ধোঁয়া যেমন সহ্য করেছে
তেমনি এর সুঘ্রাণও তার নাকে ও মনে লেগেছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের খাদেম যখন তোমাদের জন্য খানা প্রস্ত্তত করে
নিয়ে আসে তখন তাকে যদি সাথে বসিয়ে খাওয়াতে না-ও পার তাকে দুএক লোকমা
হলেও দাও। (সামান্য কিছু দিয়ে হলেও তাকে এই খানায় শরিক কর) কারণ, সে-ই তো
এই খানা প্রস্ত্তত করার কষ্ট ও আগুনের তাপ সহ্য করেছে। (সহীহ বুখারী,
হাদীস ৫৪৬০)
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়,ভালো কিছু রান্না হলে মাঝে
মধ্যে কাজের বুয়ার সন্তানদেরজন্য কিছু দেয়া উচিত। অনেক সময় খাবার বেঁচে
যায়। হতে পারে আমার ঘরের এ বেঁচেযাওয়া খাবারই কাজের বুয়ার সন্তানদের
জন্য হবে ‘ঈদের খাবার’। আর আশা করা যায় এরবিনিময়ে আল্লাহ আমার জন্য
জান্নাতের মেহমানদারির ফয়সালা করবেন।
প্রতিবেশী যদি দরিদ্র হয়
আর
প্রতিবেশী যদি দরিদ্র হয় তাহলে এ বিষয়ে তার হক আরো বেশি। কারণ দরিদ্রকে
খানা খাওয়ানো যেমন অনেক সওয়াবের কাজ তেমনি দরিদ্রকে খানা না-খাওয়ানো
জাহান্নামে যাওয়ার একটি বড় কারণ। কুরআন মজীদে ‘ছাকার’ নামক জাহান্নামে
যাওয়ার কারণ হিসেবে নামায না পড়ার বিষয়টির সাথে সাথে দরিদ্রকে খানা না
খাওয়ানোও গুরুত্ব সহকারে উল্লেখিত হয়েছে। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে,
(জাহান্নামীকে জিজ্ঞেস করা হবে) (অর্থ) কোন বিষয়টি তোমাদেরকে ‘ছাকার’ নামক
জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছে? (তারা উত্তরে বলবে) আমরা নামায পড়তাম না এবং
দরিদ্রকে খানা খাওয়াতাম না। (সূরা মুদ্দাছ্ছির ৪২-৪৪)
নিকটতম প্রতিবেশীকে আগে হাদিয়া দিব, যদিও সে বিধর্মী হয়
প্রতিবেশীর
মধ্যে যেমন আছে নিকট প্রতিবেশী, নিকটতম প্রতিবেশী ও তুলনামূলক একটুদূরের
প্রতিবেশী তেমনি আছে মুসলিম ও বিধর্মী। এখন কাকে হাদিয়া দিব বা কাকে
আগেদিব? হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম - আমার দুই প্রতিবেশী। এদের কাকে হাদিয়া দিব?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বললেন, যে তোমার বেশি
নিকটবর্তী। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০২০)
মুজাহিদ রহ. বলেন, একবার আমি
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র রা.-এর কাছে ছিলাম। তার গোলাম একটি বকরীর চামড়া
ছাড়াচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, তোমার এ কাজ শেষ হলে সর্বপ্রথম আমাদের ইহুদী
প্রতিবেশীকে দিবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ আপনার এসলাহকরুন। আপনি
ইহুদীকে আগে দিতে বলছেন! তখন তিনি বললেন, (হাঁ) আমি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রতিবেশীর হকের বিষয়টি এত বেশি
গুরুত্ব দিয়ে বলতে শুনেছি যে, আমাদের আশংকা হয়েছে বা মনে হয়েছে,
প্রতিবেশীকে মিরাছের হকদার বানিয়েদেয়া হবে। (আল আদাবুল মুফরাদ,
বুখারী,হাদীস ১২৮; শরহু মুশকিলিল আছার, তহাবী,হাদীস ২৭৯২)
প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিব
অনেক
সময় এমন হয়, প্রতিবেশীর প্রয়োজনে কিছু ছাড় দিতে হয়। কিংবা নিজের কিছু
ক্ষতি স্বীকার করলে প্রতিবেশীর অনেক বড় উপকার হয় বা সে অনেক বড় সমস্যা
থেকে বেঁচে যায়। তেমনি একটি বিষয় হাদীস শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে, যা মুমিনকে এ
বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, কোনো প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীকে তার দেয়ালে কাঠ স্থাপন করতে
বাধা না দেয়। (সহীহ বুখারী,হাদীস ২৪৬৩; সহীহ মুসলিম,হাদীস ১৬০৯)
আরেক হাদীসে এসেছে, যে তার (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে স্বয়ং আল্লাহ তারপ্রয়োজন পুরা করেন। (সহীহ মুসলিম,হাদীস ২৫৮০)
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আদান প্রদান
আমাদের
প্রায় সকলেরই সূরা মাউন মুখস্থ আছে। ‘মাউন’ অর্থ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস।
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ছোট খাট অনেক জিনিসেরই প্রয়োজন হয়। কোনো
বস্ত্তহয়তো সামান্য, কিন্তু তার প্রয়োজন নিত্য। যেমন লবন। খুবই সামান্য
জিনিস, কিন্তু তা ছাড়া আমাদের চলে না। কখনও এমনও হয় দশ টাকার লবন কেনার
জন্য বিশ টাকা রিক্সা ভাড়া খরচ করতে হবে বা এখন এমন সময় যে তা পাওয়া
যাবে না। অথচ লবন না হলে চলবেই না। তখন আমরা পাশের বাড়ি বা প্রতিবেশীর
দ্বারস্থ হই। এমন সময় এ সাধারণ বস্ত্তটি যদি কেউ না দেয় তাহলে নিশ্চয়ই
অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। কোনো প্রতিবেশী যদি এমন হয় তাহলে তাকে ধিক শত ধিক।
আল্লাহও তাকে ভৎর্সনা দিয়েছেন। সূরা মাউনে আল্লাহ বলেছেন, (অর্থ) সুতরাং
দুর্ভোগ সেই সালাত আদায়কারীদের, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা
লোক দেখানোর জন্য তা করে, এবং গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোট-খাট সাহায্য দানে
বিরত থাকে। (সূরা মাউন: ৪-৭)
হক্কে শুফ্আ
এটি
প্রতিবেশীর গুরুত্বপূর্ণ একটি হক। নিজের জমি বা বাড়ি যদি কেউ বিক্রি করতে
চায় তাহলে সে ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ
তাকে আগে জানাতে হবে যে, আমি আমার বাড়ি বা জমি বিক্রি করতে চাই তুমি তা
কিনবে কি না। যদি সে কিন তেনা চায় তাহলে অন্যের কাছে বিক্রি করা যাবে।
তাকে না জানিয়ে কারো কাছে বিক্রি করা যাবেনা। করলে সে দাবি করতে পারবে যে,
আমি এই জমি ক্রয় করব। এটা তার হক। কারণ, হতেপারে এ জমিটি তার প্রয়োজন বা
এমন ব্যক্তি তা ক্রয় করল যার কারণে সে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে
ইত্যাদি। আর একেই শরীয়তের পরিভাষায় ‘হক্কে শুফ্আ’ বলে।
হাদীস
শরীফে প্রতিবেশীর এ হকটিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কেউ তার জমি বিক্রি করতে চায়
তাহলে সে যেন তার প্রতিবেশীকে জানায়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৯৩)
আরেক
হাদীসে হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শুফ্আ’-র বিষয়ে প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি।
প্রতিবেশি উপস্থিতনা থাকলেও তার অপেক্ষা করতে হবে। এটা তখন যখন তাদের
উভয়ের চলাচলের পথ একহয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হা. ২৪৯৪; জামে তিরমিযী, হা.
১৩৬৯) এ ধরনের আরো অনেকহাদীসে হক্কে শুফ্আর বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহ পানাহ
মন্দ
প্রতিবেশী থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। কারণ একজন মন্দ প্রতিবেশী
সাধারণ জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে বা আমাকেও মন্দের দিকে নিয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মন্দ
প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।(দ্র. সুনানে নাসায়ী,হাদীস ৫৫০২;
শুআবুল ঈমান, বায়হাকী হা. ৯১০৬)
আমি হব না মন্দ প্রতিবেশী
আমি
কারো জন্য মন্দ প্রতিবেশী হব না। যেমনি ভাবে আমি চাই না যে, আমার
প্রতিবেশীটি মন্দ হোক তেমনিভাবে আমাকেও ভাবতে হবে, আমিও যেন আমার
প্রতিবেশীর কষ্টের কারণনা হই। হযরত নাফে ইবনে আব্দুল হারিস রা. থেকে
বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উত্তম
প্রতিবেশী ব্যক্তির সৌভাগ্যের কারণ...। (মুসনাদে আহমাদ,হাদীস১৫৩৭২; আল
আদাবুল মুফরাদ, বুখারী,হাদীস ১১৬)
আখেরাতের প্রথম বাদী-বিবাদী
প্রতিবেশীর
হক নষ্ট করা বা তাকে কষ্ট দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। কখনো দুনিয়াতেই এর
সাজা পেতে হয় আর আখেরাতের পাকড়াও তো আছেই। আমার অর্থবল বা জনবল আছে বলে
আমি প্রতিবেশীর হক নষ্ট করে পার পেয়ে যাব এমনটি নয়। হাঁ, দুনিয়ার আদালত
থেকে হয়ত পার পেয়ে যাব, কিন্তু আখেরাতের আদালত থেকে আমাকে কে বাঁচাবে?
হযরত উকবাইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথম বাদী-বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী।
(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৩৭২; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৮৩৬)
প্রতিবেশীকে কষ্ট দিব না
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টিকে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
কোনো ব্যক্তি মুমিন আবার প্রতিবেশীকে কষ্টও দেয় তা ভাবা যায় না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর শপথ সে মুমিন
নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবারা
জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকেতার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।
(সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৬)
আরেক হাদীসে এসেছে, যে আল্লাহর প্রতি
ঈমান রাখে ও আখেরাতে বিশ্বাস করে সে যেনস্বীয় প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।
(দ্র. সহীহ বুখারী হা. ৬০১৮)
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার বিভিন্ন রূপ হতে পারে
যেমন,
জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া, চলা ফেরার ক্ষেত্রে দৃষ্টি অবনত না রাখা,
প্রতিবেশীর বাসার সামনে ময়লা ফেলা, জোরে ক্যাসেট বাজানো, বিভিন্ন
অনুষ্ঠানের সময় প্রতিবেশীর ঘুম বা বিশ্রামের ক্ষতি করা, প্রতিবেশীর
চলাচলের রাস্তা বন্ধকরে দেওয়া, গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া
ইত্যাদি। নিজের গৃহপালিত পশু ছেড়েদিলাম আর তা প্রতিবেশীর ফসলের ক্ষতি করল
কিংবা প্রতিবেশীর অবলা পশু এসে কিছু নষ্ট করেছে বলে আমি পশুটির কোনো ক্ষতি
করলাম বা পশুর মালিককে গালি দিলাম। এসকল ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া ও ধৈর্য্য
ধারণ করা উচিত। আল্লাহ এর প্রতিদান দিবেন।
প্রতিবেশী কষ্ট দিলে কী করব?
হতে
পারে আমার প্রতিবেশী আমাকে কষ্ট দেয় তাই বলে কি আমিও প্রতিবেশীকে কষ্ট
দিব? তা হতে পারে না। মুমিন তো সর্বদা ভালো আচরণ করে। মুমিনের গুণ তো
أحسن إلى من أساء إليك
তোমার সাথে যে মন্দ আচরণ করে তুমি তার সাথে ভালো আচরণ কর।’ সে তো কুরআনের ঐ আয়াত শুনেছে
ولمن صبر وغفر إن ذلك لمن عزم الأمور.
প্রকৃত পক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা বড় হিম্মতের কাজ। (সূরাশূরা : ৪৩)
হাদীস
শরীফে এসেছে, আল্লাহ তিন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন, তাদের একজন ঐব্যক্তি, যার
একজন মন্দ প্রতিবেশী রয়েছে, সে তাকে কষ্ট দেয়। তখন ঐ ব্যক্তি ছবর করে এবং
আল্লাহর ছাওয়াবের আশা রাখে। এক পর্যায়ে ঐ প্রতিবেশীর ইন্তেকাল বা চলে
যাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৩৪০;
আলমুসতাদরাক, হাকেম খ. ২পৃ. ৮৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯১০২)
দশগুণ বেশি গুনাহ
প্রতিবেশীর
হক আদায় করা যেমন জরুরি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া বা তার হক নষ্ট করা
তেমনি মস্ত বড় গুনাহ। একই অন্যায় প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে করলে অন্যের
তুলনায় দশ গুণবেশি বা বড় বলে গণ্য হয়।
হযরত মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ
রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীগণকে
যিনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বললো, তাতো হারাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল
তা হারাম ঘোষণা করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বললেন, কোনো ব্যক্তি দশজন নারীর সাথে যিনা করলে যে গুনাহ প্রতিবেশীর
স্ত্রীর সাথে যিনা করা তারচেয়েও বেশি ও মারাত্মক গুনাহ। তারপর রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে চুরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।
তারা বললো, তাতো হারাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তা হারাম ঘোষণা করেছেন। তখন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দশ বাড়িতে চুরি করা
যত বড় অন্যায় প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি করা এর চেয়েও বড় অন্যায়।
(মুসনাদেআহমাদ, হাদীস ২৩৮৫৪; আলআদাবুল মুফরাদ,হাদীস ১০৩; শুআবুল ঈমান
বায়হাকী হাদীস ৯৫৫২)
জমির আইল ঠেলা
অনেক সময় এমন
হয় যে দুই প্রতিবেশী তাদের বাড়ির সীমানা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। যে
প্রতিবেশীর শক্তি বেশি সে জোরপূর্বক নিজের সীমানা বাড়িয়ে নেয়। এটা বসত
বাড়ির ক্ষেত্রে যেমন হয় ফসলের জমির প্রতিবেশীর সাথে আরো বেশি হয়। যাকে
বলে ‘আইলঠেলা’। সামান্য যমিন ঠেলে সে নিজের ঘাড়ে জাহান্নাম টেনে আনল।
যতটুকু যমিন সে জবরদস্তি বাড়িয়ে নিল সে নিজেকে তার চেয়ে সাতগুণ বেশি
জাহান্নামের দিকে ঠেলে নিল। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক
বিঘত জমি দখল করল, কিয়ামতের দিন ঐ জমির সাত তবক পরিমাণ তার গলায় বেড়ি
আকারে পরিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬১১)
আবু হানিফা রহ.-এর একটি ঘটনা
ইমাম
আবু হানিফা রহ. সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত, তার একজন প্রতিবেশী ছিল, যে
তাকে প্রতিদিন তার চলার পথে কষ্ট দিত। ইমাম আবু হানিফা রহ. প্রতিদিন
কষ্টদায়ক বস্তু পথ থেকে দূর করত এবং তার কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করত। একদিন
তিনি ঘর থেকে বের হলেন, কিন্তু নির্ধারিত কোনো কষ্টদায়ক বস্তু পথের মধ্যে
দেখতে পেলেন না। তিনি লোক জনের নিকট তার প্রতিবেশীর খোঁজ খবর নিলেন। তখন
সবাই তাকে জানালো যে লোকটি একটি ঘটনা ঘটিয়েছে, যার কারণে তাকে পুলিশ ধরে
নিয়ে জেল খানায় প্রেরণ করেছে। এ কথা শোনে আবু হানিফা রহ. থানায় গিয়ে
সুপারিশ করে, তাকে জেল খানা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। কিন্তু লোকটি জানতো
না যে, কে তার জন্য সুপারিশ করল?। জেল খানা থেকে বের হয়ে সে মানুষের কাছে
জিজ্ঞাসা করল, কে আমার জন্য সুপারিশ করল। মানুষ তাকে বলল, তোমার প্রতিবেশী
তোমার জন্য থানায় গিয়ে সুপারিশ করেছে। লোকটি বলল, কোন প্রতিবেশী? সবাই বলল,
আবু হানিফা। তারপর সে তাকে কষ্ট দেয়ার কারণে লজ্জিত হল এবং কষ্ট দেওয়া
হতে বিরত থাকল।
এক মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনা
প্রতিবেশীর
সাথে মানুষের সম্পর্ক সামান্য সময়ের নয়; বরং সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন, মাস
ও বছরের বা সারা জীবনের। এ প্রতিবেশী যদি মন্দ হয় তাহলে ভোগান্তির আর শেষ
থাকে না। তেমনি এক মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের কাছে এসে তার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অভিযোগ করল। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ছবর কর। এভাবে সে
তিনবার আসার পর তৃতীয় বা চতুর্থ বারে নবীজী তাকে বললেন, তোমার বাড়ির
আসবাবপত্র রাস্তায় নিয়ে রাখ। সাহাবী তাই করলেন। মানুষ সেখান দিয়ে যচ্ছিল
এবং ঐ প্রতিবেশীকে অভিশাপ দিচ্ছিল। তখন ঐ প্রতিবেশী নবীজী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বলল, আল্লাহর রাসূল! মানুষ আমাকে যা তা
বলছে। নবীজী বললেন, মানুষ তোমাকে কী বলছে? সে বলল, মানুষ আমাকে লান তকরছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার আগেই আল্লাহ
তোমাকে লানত করেছেন। সে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমি আর এমনটি করব না
(প্রতিবেশীকে কষ্ট দিব না।)। তারপর অভিযোগকারী নবীজীর দরবারে এলে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতাকে বললেন, তুমি (প্রতিবেশীর অনিষ্ট
থেকে) নিরাপদ হয়েছ। (আলমুসতাদরাক,হাকেম, হাদীস ৭৩০৩; আলমুজামুল
কাবীর,তবারানী, হাদীস ৩৫৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস৫২০)
দুই নারীর দৃষ্টান্ত; কে জান্নাতী?
প্রতিবেশীর
সাথে মন্দ আচরণ ব্যক্তির সব আমল বরবাদ করে দেয়। তাকে নিয়ে
ফেলেজাহান্নামে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি এসে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল, এক নারীর ব্যাপারে
প্রসিদ্ধ, সে বেশি বেশি (নফল) নামায পড়ে, রোযা রাখে, দুই হাতে দান করে।
কিন্তু যবানের দ্বারা স্বীয় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় (তারঅবস্থা কী হবে?)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামে যাবে।
আরেক নারী বেশি (নফল) নামাযও পড়ে না, খুব বেশি রোযাও রাখে না আবার তেমন
দান সদকাও করে না; সামান্য দু-এক টুকরা পনির দান করে। তবে সে যবানের দ্বারা
প্রতিবেশীকেকষ্ট দেয় না (এই নারীর ব্যাপারে কী বলেন?)। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সেজান্নাতী। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৬৭৫;
আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ১১৯)
প্রতিবেশীর দোষ ঢেকে রাখব
পাশাপাশি
থাকার কারণে একে আপরের ভালো মন্দ কিছু জানাজানি হয়ই। গোপন করতে চাইলেও
অনেক কিছু গোপন করা যায় না। প্রতিবেশীর এসকল বিষয় পরস্পরের জন্য আমানত।
নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণেই একে অপরের দোষ ঢেকে রাখা জরুরি। আমি যদি
তার দোষ প্রকাশ করে দিই তাহলে সেও আমার দোষ প্রকাশ করে দিবে। আর আমি যদি
তার দোষ ঢেকে রাখি তাহলে সেও আমার দোষ গোপন রাখবে। এমনকি এর বদৌলতে আল্লাহও
আমার এমন দোষ গোপন রাখবেন, যা প্রতিবেশীও জানে না। হাদীস শরীফেএসেছে, যে
তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ ঢেকে রাখে আল্লাহও কিয়ামতের দিন তার দোষঢেকে
রাখবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০)
মুসলিম ও আত্মীয় হিসেবে প্রতিবেশীর হক
প্রতিবেশীর
যত হক উপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো তো প্রতিবেশী মুসলিম হোকঅমুসলিম হোক
সবারই হক। আর প্রতিবেশী যদি মুসলিম হয় বা মুসলিম ও আত্মীয় উভয়টিইহয়
তাহলে এসকল হকের সাথে মুসলিম ও আত্মীয় হিসেবে যত হক আছে সবই তাদের
প্রাপ্য। এ বিষয়টিও স্মরণ রাখা জরুরি।
আল্লাহ আমাদের প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।