আসল ভালবাসা কখন জানলা দিয়ে পালায় না


এটা কোন কাল্পনিক গল্প নয়, সত্য ঘটনা……. যা হয়েছিল আমার এক বন্ধুর জীবনে (বর্তমানে আমার সে বন্ধু এখন সুদুর আমেরিকা প্রবাসী)।সেদিন ছিল বুধবার। ভার্সিটির ক্লাস আর আড্ডা শেষ করে লেগুনার জন্য দাড়িয়ে আছি। কিন্তু লেগুনার কোন পাত্তা নেই। অগত্যা রিক্সা নিলাম। রাপা প্লাজার সামনে এসে রিক্সা জ্যামে পড়ল। তখন দেখলাম আশিককে। আশিক আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। অনেক দিন পর দেখা তাই রিক্সা থেকে নেমে, মোটামুটি একটা ভাড়া দিয়ে আশিকের সামনে দাঁড়ালাম। “কিরে কেমন আছিস?” “আরে মেহেদি তুই? কিরে কি অবস্থা তোর?” “অবস্থা তো তোর জানতে হবে ষ্টুপিড। সেই যে টেস্ট পরিক্ষার পর গায়েব হলি আর তো খুঁজে পেলাম না তোকে’’। “সে অনেক বড় কাহিনীরে। দাঁড়া হাতের কাজটা শেষ করি তারপর তোর সাথে আড্ডা মারব।“আশিক একটা চিঠি পোষ্ট করল। তারপর আমরা একসাথে হোটেলে লাঞ্চ করলাম। তারপর দুজন দুটা বেনসন সিগারেট ধরানোর পর আমি বললাম, “এইবার বল তোর কাহিনী।“আশিক শুরু করল, “তোরা তো জানতিস আমার অবস্থা। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমার প্রধান কাজ ছিল শুধু গার্লস কলেজের সামনে দাড়িয়ে থাকা আর মেয়ে পটানো। তোরা যখন মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভয় পেতি আমি তখন তাদের সাথে ডেটিং এ যেতাম।“আমি বললাম, “কোন মেয়েই তো তোর কাছে পার্মানেন্ট ছিল না’’। আশিক আবার শুরু করল। তবে এবার আর আমি ওর কোন কথায় কিছু বলতে পারিনি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছি। “হুমম তা ঠিক। তবে তোরা যখন টেস্ট পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত তখন আমার পরিচয় হয় অর্শার সাথে।সোনার চামচ মুখে না নিয়ে জন্মালেও অর্শার বাবার সম্পত্তি, ক্ষমতা কোনটাই কম ছিল না। রাজত্ব যেমন ছিল তেমনি ওর ছিল রাজকন্যার মত রূপ। এই মেয়েটির ক্ষেত্রেও আমি আর সব মেয়ের মতই এগুচ্ছিলাম। তো, অর্শার সাথে কিছুদিন মিথ্যে প্রেম করার পর আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমি অর্শাকে আসলেই ভালোবেসে ফেলি। যার নেশা ছিল বহু নারীসঙ্গ সে যেন এক নারীতেই খুঁজে পেল সব।
ধীরে ধীরে আমি আমার সব বদভ্যাস ছাড়তে থাকি শুধু ওর জন্য। চিন্তা করতে থাকি ভাল করে পড়াশোনা করার। কিন্তু তখনি বাঁধে বিপত্তি। আমাদের ভালবাসার মাঝে এসে দাড়ায় অর্শার বাবা। সে তার সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাকে আর অর্শাকে আলাদা করে। কিন্তু বন্ধু, প্রকৃত ভালবাসা কখন পৃথক হয় না। একদিন আচমকা অর্শা আমাকে ফোন দেয়। তখন আমাদের টেস্ট পরিক্ষা চলছিল।ও আমাকে জানায় ও আমাকে ভালবাসে ও আমাকে ছাড়া খুব কষ্টে আছে। ও পালিয়ে বিয়ে করতে চায়। অর্শা কষ্টে আছে শুনে আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। সাত-পাঁচ না ভেবে এর ওর কাছে ধার করে টাকা জোগাড় করি।তারপর কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করি। অর্শার পরামর্শতেই আমরা কোর্টে গিয়ে আইন অনুযায়ী বিয়ে করি। এতে করে আমার হাত খালি হয়ে যায়। পরে অর্শার গয়না বিক্রি করার টাকা দিয়ে আমরা হানিমুনে যাই কুয়াকাটা।ওটা একধরনের আত্মগোপনও বলতে পারিস। ওদিকে অর্শার বাবাও বসে থাকেননি। তিনি আমার পরিবারে গিয়ে হুমকি দেন, আমার নামে মামলা দেন, এবং সর্বশেষ আমাকে আর অর্শাকে কুয়াকাটাতে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করান. কিন্তু কি জানিস এত কিছুর পরও একটু বিচলিত হয়নি অর্শা। পুলিশ বা জজের সামনে ঠায় দাড়িয়ে বলেছে আমি আশিককে ভালোবাসি, ও আমাকে কিডন্যাপ করে বা জোর করে বিয়ে করেনি আমি সেচ্ছায় ওকে বিয়ে করেছি। এ কথার পর ওর পরিবারের রাস্তা আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আর আমার পরিবারের কথা তো তুই জানিসই আমি মরে গেলেও সৎ মার পরিবারে ওকে নিয়ে যাব না। আর ওর এ কথা শুনে আমার মধ্যে একটা দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে। সে দায়িত্ববোধ থেকেই নাখালপাড়াতে কম টাকায় একটা বাসা ভাড়া নেই। এর ওর কাছে ধরে একটা কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরিও জুটিয়ে নিই। বেতন খুব বেশি না। খুব খাটুনি। ভাবতেই অবাক লাগে যে ছেলে আগে জিনস, টি-শার্ট পরে ভবঘুরে হয়ে ঘুরত, সে আজ ফরমাল পোশাকে মুখে এলাচি মার্কা হাসি নিয়ে ঘুরছে।মেয়েরা আসলে অনেক কিছুই পারে। একটা ছেলেকে বেলাইনে নিয়ে যেতে পারে। আবার বেলাইন থেকে লাইনে নিয়ে আসতে পারে। এতক্ষণ পর বললাম আমি, আর অর্শা? ও কি করে? আশিক বলল, “ও তো এক বিস্ময়! প্রতিদিন আমি ওর এক নতুন রূপ আবিষ্কার করি। যে অর্শা আগে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেত না সে আজ কলশি নিয়ে পানির দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে পানি সংগ্রহ করে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। নাস্তা বানায়। রান্না করে। ঘরের কাজ করে। আমি অফিস থেকে ফিরে যখন ওর ক্লান্তি মাখা মুখটা দেখি তখন আমার সমস্ত ক্লান্তি কর্পূরের মত উবে যায়। ভাবি এই কি সেই বড়লোকের মেয়ে অর্শা?এই কি আমার সেই রাজকন্যা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছিস এখন তোরা?” আশিক বলল, “খুব ভাল আছি দোস্ত, খুব ভাল আমার আর অর্শার সংসারে আরাম আয়েশ নেই, আভিজাত্য নেই, ঘরের আসবাব বলতে একটা চৌকি আর একটা কেরোসিনের চুলা। তবুও আমাদের ঘরে সুখ আছে, শান্তি আছে। অভাবের মধ্যেও আমাদের মধ্যে কোন মনমালিন্য নেই। দোস্ত মানুষ বলে না অভাব দরজায় আসলে ভালবাসা জানলা দিয়ে পালায়। ভুল বলে। আসল ভালবাসা কখন জানলা দিয়ে পালায় না, সে অভাবের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে চিরকাল’’। এটাই ছিল আশিকের শেষ কথা। তারপর আমরা বিদায় নিই।
ফিরতে ফিরতে ভাবতে থাকি আশিকের কথাগুলো। এ শহরের অনেকের কাছেই অর্থ-বিত্ত আছে কিন্তু আশিক অর্শার মত ভালবাসা নেই। আশিকের শেষ কথা তখন আমার কানে বাজতে থাকে, দোস্ত মানুষ বলে না অভাব দরজায় আসলে ভালবাসা জানলা দিয়ে পালায়। ভুল বলে। আসল ভালবাসা কখন জানলা দিয়ে পালায় না, সে অভাবের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে চিরকাল………………… বন্ধুর ভালবাসার গল্প / প্রেমের গল্প এর ইতি টানলাম।
ধন্যবাদ সবাইকে।