প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করা উচিত

সমাজে প্রতিবন্ধীদের আলাদা একটি "প্রাণী" হিসেবে দেখা হয়। প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। আমরা আমাদের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মোটেও লজ্জিত নই। সবার একই পরিচয়, আমরা বাঙালি এবং বাংলাদেশি। কেন আমাদের আলাদা করে দেখা হয়? 
প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করা উচিত
প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন পরিহার করুন। প্রতিবন্ধীরা কোন করুণার পাত্র নয়। তারা করুণা চায় না। তাদের সমান সুযোগ-সুবিধা দিলে তারাও সবার মতো যোগ্যতা নিয়ে জীবন-ধারন করতে পারে, তার প্রমাণ তারা দিয়ে আসছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীরা অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য তারা বয়ে এনেছেন গর্ব করার মতো সাফল্য। 

এদেশে প্রতিবন্ধি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হলো না, তারা তাদের নাগরিক অধিকার শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সর্বোচ্চ প্রবেশের সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা থেকে এখনো বঞ্চিত। এখনো দেশের প্রতিবন্ধিদের ৮০% দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। 

তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের যে বিশেষ দায় থাকা উচিত এ ব্যাপারে মানবতাবাদীরা বরাবরই সোচ্চার। আশার কথা সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানোকে সব সময় কর্তব্য বলে ভেবেছে। তাদের শিক্ষা ও পুনর্বাসনে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বর্তমানে সারা দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ১০৩টি সেবা ও সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে। তবে সরকার আজো প্রতিবন্ধীদের মৌলিক চাহিদা গুলো পূরণ করতে পারেনি। আমরা আশা করবো প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নেয়া সরকারের কর্মসূচিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে। 

তাদের স্বাভাবিক জীবনধারার সঙ্গী বানাতে সরকারি প্রয়াসের বাইরে বেসরকারি উদ্যোগও থাকা উচিত। সমাজের সম্পন্ন লোকেরা প্রতিবন্ধীদের প্রতি দৃষ্টি দিলে তাদের জীবন আরও সহজ হয়ে উঠবে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। বিশেষ করে যারা প্রতিবন্ধী নয় তাদেরও। প্রতিবন্ধীরা অবহেলার পাত্র নন। তাদেরও সমান সুযোগ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী। কিন্তু তারপরও প্রতিবন্ধীরা সামাজিকভাবে এখনো পুরোপুরি অধিকারপ্রাপ্ত হয়নি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ জন্য দায়ী। 

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। আর এ ১০০ কোটি জনগোষ্ঠীর আবার বেশিরভাগই আমাদের মতো উন্নয়ন রাষ্ট্রগুলোতে বসবাস করে। তার মানে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। তবে, এই প্রতিবন্ধীতার বিভিন্ন রকমফের আছে। কোনোটি দৃষ্টিগোচর হয়, আবার কোনোটি অতোটা প্রকট নয়। তাই ততোটা গুরুত্ব পায় না। 

মূলত শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধীদেরই আমরা বিবেচনা করি। প্রতিবন্ধীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তারা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাই এ বৈষম্য ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মূল কারণ। একটি অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অসচেতন জনগোষ্ঠী কখনোই প্রতিবন্ধীদের মতো সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করতে পারে না। কারণ, অশিক্ষা বা অসচেতনতার জন্য তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কেই ধারণা রাখে না। ফলে, ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কেবল হত্যা, খুন বা অপহরণ নয়। সাধারণ ফৌজদারি বা দেওয়ানি অধিকার রক্ষা করতে না পারাই সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমাদের সংবিধানেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা আছে। তাই সংবিধানের আলোকে তাদের জন্য অধিকার বান্ধব একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। 

মনে রাখতে হবে যে, তারা আমাদেরই একজন। এ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে রয়েছে তাদেরও সমান অধিকার ও অবদান। আন্তর্জাতিক পরিসরে শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে বিশ্ব। বাংলাদেশ এ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী সে সাফল্যের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই অধিবেশনে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ যিনি দেশে প্রতিবন্ধী অধিকার রক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার এ ভূমিকা বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়েছে, খ্যাতি লাভ করেছে।

বাংলাদেশ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০১৩ সালে প্রতিন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন করেছে। ২০১৩ সালের আইনের মাধ্যমে ২০০১ সালের আইনটি রহিত করা হয়েছে। আইনানুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিীার ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব বিবেচনায় প্রতিবন্ধীদের সাধারণভাবে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এ আইনের ১৬ ধারায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। 

একজন প্রতিবন্ধীর যেসব অধিকার আছে: 

১. প্রত্যেক প্রতিবন্ধীর পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়ায়।

২. সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতার।

৩. উত্তরাধিকারপ্রাপ্তির।

৪. স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তির।

৫. মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সাথে সমাজে বসবাসের, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন করার। 

৬. প্রবেশগম্যতার। ৭ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের। 

৮. শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণের। 

৯. সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তির।

১০. কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকবার, অন্যথায়, যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তির। 

১১. নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তির।

১২. প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির।

১৩. শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে 'প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ সুবিধা' প্রাপ্তির। 

১৪. শারীরিক, মানসিক ও কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করে সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে সহায়কসেবা ও পুনর্বাসন সুবিধাপ্রাপ্তির। 

১৫. মাতা-পিতা বা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বা তার আবাসন ও ভরণ-পোষণের যথাযথ সংস্থান না হইলে, যথাসম্ভব, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসনের। 

১৬. সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকা-ে অংশগ্রহণের; শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, যথাসম্ভব, বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে গ্রহণের। 

মোদ্দা কথা, একজন প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যাবতীয় অধিকারেরই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে আমাদের বিদ্যমান আইনে। প্রয়োজন কেবল সে আইনের বাস্তবায়ন ও সাধারণের সচেতনতা। প্রতিবন্ধীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের উন্নয়নের অংশীদার করে গড়ে তুলতে হবে। 

একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, প্রতিবন্ধীদের সমস্যাটি যত ব্যাপক, সে অনুযায়ী সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব দেয়া হলেও বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের ততোটা মূল্যায়ন করা হয় না। ব্যক্তিগতভাবে অনেক মহৎ ব্যক্তি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও ব্যাপক পরিসরে প্রতিবন্ধীদের সমস্যা দূর করতে সামাজিক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। প্রতিবন্ধীরা নিজ পরিবারেই নিগৃহীত হয়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যারা অবহেলিত, সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষদের কল্যাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে কী উদ্যোগ নেয়া হলো- এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা অন্য যে কোনো কারণে কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে যে কোনো সময় প্রতিবন্ধীর বিড়ম্বিত ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে। প্রতিবন্ধীদের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- সংঘটিত করে, যা অত্যন্ত দুঃখ জনক। এসব সমস্যার সমাধানে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের নামে বরাদ্দ অর্থ ও অন্য সহযোগিতা নিয়ে যেন দুর্নীতি না হয়, সেদিকেও রাখতে হবে কঠোর দৃষ্টি।

প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে, একমাত্র পারিবারিক সচেতনতাই পারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। 
সুতরাং...... নিজে সচেতন হোন। অন্যকেও সচেতন করে তুলুন।